দিল্লির দাঙ্গা নিয়ে যা বললেন ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
এম কে নারায়ন - সংগৃহীত
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)-এর বিরুদ্ধে শতাধিক দিনের প্রতিবাদ ও ১৯৮৪ সালের পর দিল্লির সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কয়েক সপ্তাহ পর কী ভুল হলো সেই প্রশ্নই জাগছে। এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এর মূলে রয়েছে সম্মিলিত ব্যর্থতা, এটি পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলেও সীমিত করা যেতে নিশ্চিতভাবেই।
যে মিশ্রণে জ্বলে ওঠল
অনেকে দিল্লির দাঙ্গায় ১৯৮৪ সালের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। এই তুলনা যথাযথ নয়। ১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গায় কর্তৃপক্ষ হতবাক হয়ে পড়েছিল। আর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পার্লামেন্টে সিএএ পাস হওয়ার পর থেকেই দেশে এক ধরনের ধিকি ধিকি আগুনে পুড়ছিল। সময় যতই গড়াচ্ছিল, সিএএর ব্যাপ্তি বাড়ছিল, বিশেষ করে দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুর মতো নগর কেন্দ্রগুলোতে। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, ইচ্ছাকৃত উদাসিনতার মিশ্রণের ফলে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে এবং সামাজিক অনৈক্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে ধৈর্যহীনতার প্রকাশ এবং সর্বোপরি মেরুকরণ করা পরিবেশ সঙ্ঘাতের সূচনা ঘটিয়ে দেয়।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে এম যোশেফের কথায়, পুলিশের সময়োচিত পদক্ষেপ অনেক প্রাণ বাঁচাতে পারত। সহিংসতা দমনে কার্যকর হস্তক্ষেপ না করায় দিল্লি হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টও দায়ী ছিল। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এক বিচারপতি যুক্তি দিয়েছেন যে বিচার বিভাগ যদি আরো সক্রিয় হতো, তবে সাম্প্রতিক সহিংসতা রোধ করা যেত। ভারতের প্রধান বিচারপতি শরদ বাবদে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে সহিংসতা দমনে চাপ সৃষ্টির মতো পর্যাপ্ত হাতিয়ার নেই আদালতের।
রাজনীতি
দাঙ্গার সময়ের বিষাদময় দৃশ্যে রাজনৈতিক শ্রেণী উল্লসিত হয়েছিল বলে মনে হয়েছে। পালামেন্টের একজন সদস্য ও একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেক শীর্ষস্থানীয় সদস্যও উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। বিরোধী দলের দায়িত্বহীনতাও কম ছিল না। রাজনৈতিক বিভক্তির উভয় অংশের প্ররোচনা তাই সহিংসতায় ব্যাপকভাবে ইন্ধন দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকার এই সহিংসতা দমনে স্পষ্টভাবেই অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। অথচ দিল্লির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়দায়িত্ব প্রধানত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। বলা হচ্ছে, উত্তরপূর্ব দিল্লির পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু তিনি বলতে গেলে কিছুই করেননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অনুমান করছেন যে সাম্প্রতিক দিল্লির নির্বাচনে যে ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি, তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি ওই মন্ত্রণালয়।
তবে সদ্য পুনঃনির্বাচিত আম আদমি পার্টির সরকারও কম দায়ী নয়। মুখ্যমন্ত্রী যদি দ্রুত তার কর্তৃত্বের মধ্যে থাকা শক্তির আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন, তবে সহিংসতা এত দূর ছড়াতে পারত না।
এরপর দায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা ও পুলিশ। পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী এই সহিসংতা দমনে পুরোপুরি অক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। পুলিশ যেখানে জামিয়া মিল্লিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহেরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করেছে, সেখানে এই সহিংসতায় নিস্ক্রিয় থেকেছে।
একটি ভ্রান্তি
সহিংসতার আগেই যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে করে যেকোনো মুহূর্তে তা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। উভয় পক্ষ থেকেই উস্কানি ছিল। কিন্তু যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না, তা হলো এই যে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সাম্প্রদায়িকতাকে আরো উত্তপ্ত হতে দিয়েছেন উস্কানিমূলক কথা বলে।
বড় ধরনের কোনো দাঙ্গা হলেই পুলিশকে দায়ী করা হয়ে থাকে। অনেক সময় তারা বেখেয়াল থাকে। তবে দিল্লিতে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এখানকার পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে নয়, বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যের লে. গভর্নরের মাধ্যমে পুলিশকে কাজে লাগিয়ে থাকেন। কিন্তু পুলিশকে ব্যবহার করা হয়নি।
ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়ে থাকে যে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এমনটি হয়েছে। এমনটি যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তবে এর জন্য খুবই বড় মূল্য দিতে হবে।
সবার জন্য টার্গেট
দিল্লির দাঙ্গা পরমাণু বিজ্ঞানের শ্রেণীতে পড়ে না। ধীরে ধীরে উত্তেজনা বাড়ছিল এবং তা সবার নজরে ছিল। ফলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বা প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত ছিল। পুলিশ বাহিনীর যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক না কেন, তাদের তা দমন করা উচিত ছিল। কিন্তু তা করতে না পারারফ ফলে এটি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য লজ্জার কারণে পরিণত হয়েছে। আর এতে করে কেবল জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনই নয়, সেইসাথে অনেক দেশই আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলছে।
দিল্লির লজ্জা ভারতের লজ্জা। এবার যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা গেল, তাতে করে গোলযোগকারীরা ভবিষ্যতেও এর সুযোগটি গ্রহণ করতে পারে।
আমরা এখন অবর্ণনীয় নতুন নতুন বিপদের মুখে রয়েছি। অথচ দিল্লি পুলিশ এই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে তারা অদক্ষ, অকার্যকর। তারা এমনকি সাধারণ দাঙ্গা পর্যন্ত দমন করতে পারে না।
লেখক : ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক গভর্নর
দি হিন্দু