এক বছরে ঋণ ৭২ হাজার কোটি টাকা
এক বছরে ঋণ ৭২ হাজার কোটি টাকা - সংগৃহীত
ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এক বছরে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা। গত ৮ মাস ৫ দিনেই সরকার এই ঋণ নিয়েছে ৫৩ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এ অস্বাভাবিক ঋণ নেয়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। আবার ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে থেকেও আগের মতো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। উন্নয়ন ব্যয় ঠিক রাখতে সরকার বাধ্য হয়েই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিচ্ছে। ঋণ নেয়ার এ ধারা অব্যাহত থাকলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আরো চাপে পড়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি অনুযায়ী বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ধারেকাছেও যেতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের ৫ মার্চ সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের স্থিতি ছিল ৮৯ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে হয়েছে ৭১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা বা প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা। আবার অর্থবছরের হিসাবে, গত অর্থবছরের শেষ দিনে অর্থাৎ ৩০ জুনে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৯৫ কোটি টাকা।
আর ৫ মার্চ পর্যন্ত ঋণের স্থিতি বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের হিসাবে ৮ মাস ৫ দিনে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে ৫৩ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অথচ পুরো অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, যে হারে ঋণ নেয়া হচ্ছে এই একই হারে ঋণ নিলে বছর শেষে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বছরের শেষ সময়ে ঠিকদারের বিলসহ সরকারের নানা উন্নয়ন কাজের দায় পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে শেষ মাসে ঋণ অন্য সময়ের চেয়ে বেশি নিতে হয়।
ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এ অতিমাত্রায় ঋণ নেয়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, গত বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার অতিমাত্রায় ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরে কাক্সিক্ষত হারে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে টিআইএন বাধ্য করা হয়েছে। আগে যা বাধ্য ছিল না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ( জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা, সেখানে চলতি বছরের একই সময়ে তা কমে নেমেছে মাত্র ৭ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে গত বছরের চেয়ে এক-চতুর্থাংশ ঋণ পেয়েছে সঞ্চয়পত্র থেকে। এত দিন যতটুকুু সঞ্চয়পত্র থেকে বিনিয়োগ আসছিল তার বেশির ভাগই ছিল ডাকঘর সঞ্চয়পত্র থেকে। কিন্তু এখন সেই ডাকঘর সঞ্চয়পত্রেও টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ফলে সামনে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আরো কমে যেতে পারে। এর ফলে সরকারের ব্যাংক-নির্ভরতা আরো বেড়ে যাবে।
এ দিকে কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জানুয়ারি মাসে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ২৫ শতাংশ, যেখানে গত বছরের জানুয়ারিতে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। সামনে রাজস্ব আদায়ের চলমান প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যয় ঠিক রাখতে সরকারকে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেশিমাত্রায় ঋণ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের ধারা অব্যাহত থাকলে মুদ্রানীতি অনুযায়ী বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ধারের কাছেও যেতে পারবে না। চলতি বছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্তু হালনাগাদ তথ্যমতে গত জানুয়ারি শেষে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। এমনিতেই ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। ব্যাংকগুলোর ৯ শতাংশ ঋণের সুদহার কার্যকর করতে হবে আগামী ১ এপ্রিল থেকে। এ ঋণের সুদহার কার্যকর করতে গিয়ে বেশির ভাগ ব্যাংকই গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এতে আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরে নিচ্ছেন। বেশি মুনাফার আশায় নানা খাতে বিনিয়োগ করছেন তারা। এ কারণেই আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। আমানতের প্রবৃদ্ধি না বাড়ায় ব্যাংকগুলোতে এরই মধ্যে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
প্রতিদিনই ব্যাংকগুলো তাদের সঙ্কট মেটোতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকারও ওপরে ধার নিচ্ছে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো। এটা অব্যাহত থাকলে সামনে ব্যাংক খাতে টাকার সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে। এর পাশাপাশি সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অধিকমাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ দেয়ার মতো ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ হাতে থাকবে না। এতে চাপে পড়ে যাবে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর। পরিস্থিতি উন্নতি না হলে বেসরকারি বিনিয়োগ আরো কমে যাবে। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও বাধাগ্রস্ত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।