ইতালিতে আইসোলেশন : একটি কঠিন অভিজ্ঞতা

সিলভিয়া স্কিওরিলি বোরেলি | Mar 12, 2020 08:57 pm
ইতালিতে আইসোলেশন

ইতালিতে আইসোলেশন - সংগৃহীত

 

গত সোমবার শেষ রাতে যখন ইতালির দেশব্যাপী বন্ধ করার খবর প্রথম প্রচারিত হলো, আমি তখন আমার চাচার ৭০তম জন্মদিনের ডিনারে অংশ নিচ্ছিলাম। লুম্বারদিতে সপ্তাহান্তে করোনাভাইরাস নিয়ে কঠোর কড়াকড়িমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেক্ষাপটে আমার মা-বাবা বাইরের রেস্তোরাঁ এড়াতে তাদের বাড়িতেই (মহামারিটি ছড়িয়ে পড়ার মূল কেন্দ্র থেকে৬০০ কিলোমিটার দূরে) ডিনারটির আয়োজন করেছিলেন।

স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশিকা অনুসরণ করে আমরা ২ মিটার চওড়া টেবিলটির প্রতিটি দিকে একে অপরের কাছ থেকে এক মিটার দূরে বসেছিলাম। দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিই সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছিল। প্রধান পদটি পরিবেশনের সময় আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম যে আমি টেলিভিশনটি চালু করতে চাই। ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রী গিউসেপে কন্টে ঘোষণা করেছেন যে পুরো দেশ বন্ধ থাকবে। এ কথা শুনেই সব অতিথি (আমি ছাড়া তাদের সবাই ছিলেন ৬০ ও ৭০-এর বেশি বছর বয়স্ক) খাওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেললেন, আনন্দ নিমিষেই বিষণ্নতায় পরিণত হলো।
কন্টে বললেন, আমাদের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।

চিকিৎসকেরা ইতালির পরিস্থিতিকে যুদ্ধের মতো অবস্থা হিসেবে অভিহিত করলেন, হাসপাতালগুলোতে রোগী উচপে পড়তে লাগল, মেক্যানিক্যাল ভেন্টিলেশনের স্বল্পতার কারণে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের স্টাফদের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছিল, তারা কাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করবে।
গত বছর আমার চাচা তার স্ত্রীকে (ফুসফুসের জটিলতায়) হারিয়েছিলেন। চাচার জন্মদিনে করোনাভাইরাসের রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া নিয়ে বিরামহীন আলোচনা চলতে থাকায় তার মনে কী ঝড় বইছিল, তা আমি কেবল অনুমানই করতে পারছিলাম।
আমি আমার মা-বাবার বাড়ি ত্যাগ করে ভাবতে লাগলাম, কখন আমাকে ফিরতে দেযা হবে। আমার মায়ের নানা ধরনের স্নায়ুবিক সমস্যঅ ছিল। তিনি হাঁটতে পারেন না, গত দুই বছরে তার স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। সোমবার সকালেই মিলানে আমার অন্যতম বান্ধবী আমার মেয়েকে নিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে স্ব-আইসোলেশনের বদলে মা-বাবার বাড়িতে যাচ্ছি শুনে আমাকে বকা দিয়েছিল। তার পার্টনার চিকিৎসক। তিনি কাজ করেন দেশের উত্তরাঞ্চলে। তিনি বললেন : ‘তুমি সাংবাদিক। তুমি বুঝতেই পারছ না।‘ সে আসলে বোঝাতে চাইছিল যে আমি আমার পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের ঝুঁকিতে ফেলতে যাচ্ছি।

সকালে আমার মায়ের চিকিৎসকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমি মায়ের কাছে যেতে পারি কিনা। তিনি কিছু সময়ের জন্য যাওয়াটা এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে ব্যস্ত থাকায় অবাধে যেকোনো সময় কোথাও যেতে পারি না। ওই চিকিৎসক বললেন, আমার বাবার আশপাশে যাওয়াটা নিরাপদ নয়।

তিনি বর্তমানে আবরুজ্জো অঞ্চলে মাঝারি আকারের একটি শহরের মেয়র। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে তিনি গত দুটি সপ্তাহ স্থানীয় লোকজন ও রোমে সাথে সভা করে কাটিয়েছেন। গত কয়েক বছরে ব্যয় সঙ্কোচনের জন্য উত্তরের হাসপাতালগুলোর মান হ্রাস করা হয়েছে। এখন হাতে থাকা কয়েকটি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট দিয়ে কিভাবে সমস্যাটি মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ চিন্তা করতে লাগল।
আমি মাকে ফোন করতে চেয়েছিলাম, এ কথা জানাতে যে আমি যাব না। কিন্তু তারপর মনে হলো, তিনি যখন ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে যাবেন, তখন পরার জন্য একটি ফেস মাস্ক দরকার তার। আমি রোমের ১২টি ফার্মেসিতে ফোন করলাম। কোথাও নেই। সারা দেশেই একই অবস্থা।
শেষ পর্যন্ত আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু, ৪৪ বছর বয়স্ক ক্যান্সার রোগী, আমার মায়ের জন্য একটি অবশিষ্ট মাস্ক দিতে চাইলেন।

ততক্ষণে ওই ফিজিওথেরাপিস্ট আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি ৩ এপ্রিল (ওই দিন পর্যন্ত জরুরি বন্ধের মেয়াদ ঘোষণা করা হয়েছে) পর্যন্ত কাজ করা বন্ধ রাখছেন। ফলে মাস্কটির দরকার ছিল না। কিন্তু তবুও আমি মাস্কটি সাথে নিলাম।
আমি এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার দুইা তরুণ প্রতিবেশীর মুদি সামগ্রী ও ওষুধ সংগ্রহ করতে বয়স্ক ও প্রবীণ প্রতিবেশীদের সহায়তা করার দৃশ্যে মুগ্ধ হলাম। মিলানে আমার সাংবাদিক বন্ধুরা জানিয়েছিলেন যে উত্তর এলাকাতেও এ ধরনের বিষয় দেখা যাচ্ছে।
আমার মাস্ক রেখে আসার পর আমি দ্রুত বেগে আমার ৩২ মাসের মেয়ের কাছে ছুটলাম। রোম ভুতুরে নগরীতে পরিণত হয়েছে। ৭ কিলোমিটার ড্রাইভ করতে সময় লাগল ৯ মিনিট। অথচ আগে সবচেয়ে কম যানবাহনও যখন থাকত, তখনো লাগত এর অন্তত দ্বিগুণ সময়।
বাসায় মেয়েটা অনেক আগেই দিবানিদ্রা থেকে জেগে গেছে। বৃহস্পতিবার থেকে নার্সারি বন্ধ। ৬ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
আরো অনেকের মতো আমরাও বিপদে পড়েছি। চাইল্ড কেয়ার কর্মী নিয়োগ করতে পারছি না এই ভয়ে যে তারা হয়তো ভাইরাসটি নিয়ে আসবে।

খেলার স্থানগুলোতে যাওয়া বারণ। আমাদেরকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বাড়িতেও যেন দলবদ্ধভাবে না খেলি। অথচ ইতালিতে বসন্তের এই সূচনার সময় শিশুদের বাড়িতে বন্দী করে রাখাটা অকল্পনীয় বিষয়।
আমি কী করতে পারি? বেশ কয়েকটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে অন্যান্য মা-বাবার সাথে বাড়িতে কিভাবে বিনোদনের ব্যবস্থা করা যায় কিংবা কী রান্না করা যায়, তা নিয়ে মত বিনিময় করতাম। কয়েকটি হাই স্কুলে অনলাইনে ক্লাস করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক ছাত্রের কাছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দৈনন্দিন ভিত্তিতে হোমওয়ার্ক পাঠানো হয়।
লা ৭ টেলিভিশনের মতে, বেশির ভাগ মা-বাবা স্কুল বন্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্ত তারা সমর্থন করেন। অথচ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলৈাতে রাজনীতিবিদদের নিয়ে ক্ষোভ ছিল সবার মধ্যে।

আর অনুষ্ঠান, বিমান, ম্যানিকিউর সেলুন ইত্যাদি থেকে বাতিলের খবর বন্যার মতো আসছিল। এসব পেশার লোকজন টাকা না পেলে কিভাবে বাঁচবে, সে চিন্তাও মনে উদয় হয়েছিল।

সরকর অবশ্য ভর্তুকি দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। তবে তাতে স্বস্তি পাওয়া দায়।
কাজে ফেরার আগে আমার শেষ চিন্তা ছিল আমার স্বামীকে নিয়ে। তিনি কাজ করেন লন্ডনে। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে তার পক্ষে খুব শিগগিরই আমাদের সাথে মিলিত হওয়া সম্ভব হবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবারে এ ধরনের বিচ্ছেদের কথা কেউ কল্পনাও করেনি। হয়তো চিকিৎসকেরাই ঠিক। আমরা আসলেই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রয়েছি।

পলিটিকো


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us