বাজেট বাস্তবায়নের এই দুরবস্থা কেন?
জাতীয় সংসদ - ছবি : সংগ্রহ
নতুন বছরের (২০২০-২১) বাজেট তৈরির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাক-বাজেট আলোচনা আগামী ১৯ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এরপর নতুন বছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হবে। অর্থবছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ের তথ্য-উপাত্ত সামনে রেখে নতুন বাজেটের কাজ শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির উইপোকা খ্যাত করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে বাংলাদেশে। চীনের উহান থেকে এর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ইতোমধ্যে চীনা অর্থনীতিকে এটি এমনভাবে আঘাত হেনেছে যে, স্বাভাবিক শক্তিমত্তা ফিরে পেতে দেশটির অর্থনীতির কত সময় প্রয়োজন হবে তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে।
বাংলাদেশে সবেমাত্র দৃশ্যমান হয়ে ওঠা করোনার আঘাত সবশেষে কোন পর্যন্ত পৌঁছে এখনো তা কল্পনার মধ্যে রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে দু’টি প্রধান খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে করোনায়। এই ক্ষতি হবে রফতানি এবং উৎপাদন হ্রাসে আর সেই সাথে অভ্যন্তরীণ লেনদেন ও চাহিদা কমে যাওয়ায়। করোনার আপদ বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে এমন এক সময় এসে হাজির হয়েছে যখন ৮.১৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের হিসাবের তাজ মাথায় থাকা অবস্থায় অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে মন্দা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আর এর তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখা যাবে আসন্ন বাজেটে।
জাতীয় বাজেটের দু’টি প্রধান দিক হলো আয় এবং ব্যয়। আয় না করে ব্যয় হলে ধারদেনায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়তে হয় রাষ্ট্রকে। এ জন্য সরকারের আয় বা রাজস্ব আহরণ রাষ্ট্রের বাজেট বা অর্থনীতির জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়টা আমরা পার হয়ে এসেছি। এই বছরটিতে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, স্থির হিসাবে ৮.১৫ শতাংশ অর্থনৈতিক বিকাশ হয়েছে। বিশ্বের যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রবৃদ্ধির এই হার নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। অথচ এই সময়ের চূড়ান্ত হিসাবে বাজেটের মূল লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ পাঁচ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বাস্তবে আদায় হয়েছে মাত্র দুই লাখ ২৫ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৮০ হাজার কোটি টাকা এবং সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী ৫ দশকে একটি রেকর্ড। এত বড় রাজস্ব ঘাটতি বাংলাদেশে আর কখনো হয়নি। এর ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য সরকারের রাজস্ব আয়ের যে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ১৯.৩ শতাংশ ঠিক করা হয়েছিল, তা ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। (দেখুন : রাজস্ব পরিস্থিতির মাসিক রিপোর্ট অক্টোবর ২০১৯, অর্থ মন্ত্রণালয়)। বিগত ৪ দশকে রেকর্ড প্রবৃদ্ধির এই অর্থবছরেও সরকারের আয় বিপর্যয়ের কারণে মোট রাজস্ব আদায় জিডিপির ৯.৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরের এই অনুপাতকে ১৩.০৯ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায়।
প্রশ্ন হলো, চলতি অর্থবছরের ৮ মাস পেরিয়ে গেছে, এই সময়ে সরকারের রাজস্ব আয়ের বাস্তব চিত্রটি কী? বিগত বছরের রাজস্ব বিপর্যয়ের কারণে এবার যেখানে ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা, সেখানে অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সার্বিক রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.২ শতাংশ। এ সময়ে ৬৮ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা মোট রাজস্ব আদায় হয়, যা সারা বছরের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২০ শতাংশ। এই হারে যদি রাজস্ব আদায় হয় তাহলে বছর শেষে জিডিপির ১৩ শতাংশের সমান রাজস্ব আদায় হিমালয়সম দুর্গম এক লক্ষ্যে পরিণত হবে। বরং রাজস্ব আহরণ আগের বছরের জিডিপির ৯.০ শতাংশ থেকেও আরো নিচে নেমে আসতে পারে। এনবিআরের কর রাজস্বের হিসাব ৭ মাসে সাড়ে ৭ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে। করোনা আক্রান্ত শেষ ৪ মাসে রাজস্ব আহরণের বাস্তব অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে তা আমদানির চিত্র সামনে রাখলে কিছুটা স্পষ্ট হবে। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে আমদানি আগের বছরের তুলনায় পৌনে ৩ শতাংশ কমে গেছে। আর এই সময়ে নতুন ঋণপত্র স্থাপনের তথ্য সামনে রাখলে স্পষ্ট হবে বছর শেষে আমদানি ৭-৮ শতাংশ কমে যেতে পারে।
আমদানি খাত থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে। আর এই সময়ের রফতানি চিত্র আরো নেতিবাচক হওয়ায় সার্বিক উৎপাদন খাতের দুরবস্থারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ অবস্থায় বছর শেষে ৫০ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ৫০ থেকে ০ বিদায় করে ৫ শতাংশে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নেমে আসে কি না সন্দেহ রয়েছে। আর সেটি হলে নতুন বছরের বাজেট কিসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হবে বলা মুশকিল।
সাধারণভাবে সরকারের আয় কমে গেলে ব্যয়ের রাস টেনে ধরার কোনো বিকল্প নেই। আর সেটি না করা হলে সরকারকে প্রশাসন চালানো রাজস্ব ব্যয় এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ধারদেনা করতে হয়। দেশের ধারদেনা নেয়ার দু’টি সূত্র হলো ব্যাংক খাত আর সঞ্চয়পত্র খাত। দেশের মানুষ সঞ্চয়পত্র না কিনলে তা থেকে ধার পাওয়া যায় না। আর মানুষের হাতে টাকা না থাকায় এই বছরের প্রথম ৬ মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ৭৮ শতাংশ কমে গেছে। ফলে ভরসা দাঁড়াচ্ছে ব্যাংক খাত। ব্যাংক খাত থেকে ধার নিতে সরকারের কার্যত কোনো বাধা নেই, এতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রাপ্তির সুযোগই কেবল সীমিত হয়। আর আর্থিক ভারসাম্যও তাতে ব্যাহত হয়। সরকারের আয়ের দুর্গতির পরও চলতি খরচ বজায় রাখতে গিয়ে ব্যাংক খাত থেকে অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে সাড়ে ৩৮ শতাংশ বাড়তি ঋণ নিতে হয়েছে। এ সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে মাত্র সোয়া ৪ শতাংশ। (দেখুন : মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটর্স : মান্থলি আপডেট ; ফেব্রুয়ারি ২০২০, বাংলাদেশ ব্যাংক)। ব্যাংক খাত থেকে ধার নিয়েও ব্যয় নির্বাহ সম্ভব না হওয়ায় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিলের দুই লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি তহবিল সংসদে আইন পাস করে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে বিদেশে সূত্র থেকে ঋণ প্রাপ্তিও দুরূহ হতে পারে। অর্থবছরের প্রথমার্ধে বিদেশী উৎস থেকে নিট অর্থপ্রাপ্তি ৭.৬ শতাংশ কমে গেছে অথচ আগের বছর ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। অর্থবছরের বাকি সময় বিদেশী অর্থপ্রাপ্তি আরো কমে যেতে পারে, বিশেষত চীনা উৎস থেকে। এর মধ্যে সেতুমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন, পদ্মা সেতুর কাজ ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে।
এ বাস্তবতায় বাজেট বাস্তবায়নের বাস্তব যে চিত্রটি দাঁড়াচ্ছে তা হলো, সরকারের আয়ে রেকর্ড পরিমাণে ঘাটতি আর এই ঘাটতির জন্য সরকারকে ঋণ নিয়ে রাজস্ব ব্যয় ও জরুরি উন্নয়ন খরচ সামাল দিতে বাধ্য হওয়া। এতে বাজেট ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক উপরে উঠে যেতে পারে। একপর্যায়ে দেশী ও বিদেশী কোনো উৎস থেকে আর ঘাটতি অর্থায়ন করা যাবে না। তখন বাজেটের বরাদ্দগুলো ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করতে হবে। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়গুলোকে সংশোধিত বাজেটে ২০ শতাংশ করে গড় কাটছাঁট করে বাজেট প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে।
সংশোধিত বাজেটের এই কাটছাঁটের অর্থ দাঁড়াবে নতুন অর্থবছরের বাজেট ভিত্তি নিচে নেমে যাওয়া। বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা হলে স্বাভাবিকভাবে ২০২০-২১ সালের বাজেটে গতানুগতিকভাবে চলতি মূল্যে আগের বছরের মূল বাজেটের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। জিডিপির অনুপাতে বাজেটের সব ক’টি লক্ষ্যমাত্রা অনিবার্যভাবে কমবে। আর যদি চলতি অর্থবছরের মতো বাস্তবায়নের কথা মাথায় না রেখে বাজেট তৈরি করা হয় তাহলে যেকোনো সংখ্যায় লক্ষ্যমাত্রা নির্র্ধারণ করা সম্ভব হতে পারে।
প্রশ্ন হলো, যেখানে ৭-৮ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেখানে বাজেট বাস্তবায়নের এই দুরবস্থা কেন দেখা যাচ্ছে? রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে কেন যাওয়া যাচ্ছে না? অথচ রাজস্ব ব্যয় অব্যাহতভাবে বাড়ানো হচ্ছে। আসলে অর্থনীতির মূল ভিত্তি শক্তিশালী না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য আঁকা হয়েছে। ফলে অর্থনীতির এক সূচকের সাথে আরেক সূচকের মিল পাওয়া যায়নি। বলা হচ্ছে, অর্থনীতি ৭-৮ শতাংশ হারে বিকশিত হয়েছে। অথচ শেয়ারবাজার মৃতপ্রায়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় বাজারের শেয়ার সূচক এখন তলানিতে। ব্যাংকগুলোতে অকার্যকর ঋণের অঙ্ক ক্রমেই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কোনো লক্ষণ বাস্তব কর্মবাজারে নেই। অর্থনীতির চিত্র প্রকাশে রাজনীতির মতোই এক ধরনের রেজিমেন্টেশনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বাস্তবে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে। এক দিকে আমদানি কমে যাচ্ছে আর অন্য দিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর শিল্পজাত উৎপাদনেও নিম্নগতি দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থার আশঙ্কা রফতানি খাতে। করোনার প্রভাবের আগেই অর্থবছরের ৭ মাসে রফতানি আয় পৌনে ৩ শতাংশ কমে গেছে। শেষ চার মাসে বড় ধরনের আয় পতনের আশঙ্কা পোশাক রফতানিকারকদের।
আমদানি খাত এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতে দুরবস্থা দেখা দিলে রাজস্ব আদায় কোনোভাবে বাড়ানো যায় না। করপোরেট আয়কর প্রধানত ব্যাংকের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলো অনিয়মিত ঋণ নিয়মিত করে মুনাফার বাড়তি অঙ্ক দেখাচ্ছে। এতে প্রদর্শিত মুনাফার ৪৫ শতাংশ সরকারের কোষাগারে আয়কর হিসেবে জমা হচ্ছে। কিন্তু যে অর্থ কোনো দিন ব্যাংকের কাছে ফিরে আসবে না, সেটি মুনাফা দেখিয়ে বণ্টন করার এ কাজে ব্যাংকের মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী নিজেই সংসদকে জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতের পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা পরিচালকরা পরস্পরের সাথে বোঝাপড়া করে নিয়ে গেছেন। এই হিসাব বেনামে তারা যে অর্থ নিয়েছেন তার বাইরে। ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি যারা ভেতর থেকে পর্যবেক্ষণ করেন তাদের হিসাব অনুসারে, এই অর্থের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি ছাড়া কম হবে না। এক দশক অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে অবসরে যাওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত পরিচালকদের কাছ থেকে এই অর্থ আদায় করার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। লুটপাটের কারণে ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়া ঠেকাতে তার নিজের পদক্ষেপকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, প্রয়োজনে ১০, ২০ এমনকি ৩০টি ব্যাংক যদি বন্ধও হয়ে যায় তবুও এই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। (পড়–ন : সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিতের সাক্ষাৎকার, দৈনিক যুগান্তর : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। আসলে আর্থিক খাতের স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নিতে হবে। সব অনিয়মিত ঋণ নিয়মিত বা পুনঃতফসিল করার পরও খেলাপি হওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অচলাবস্থা নেমে আসতে পারে।
দেশী-বিদেশী নানান পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত ও অর্থনীতি থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা বের হয়ে যাওয়ার চিত্র আসছে। যারা ব্যাংকগুলোর ভেতরের খবর রাখেন তারা এসব জানেন। ১০ লাখ কোটি টাকার মতো ব্যাংকঋণের মধ্যে আইএমএফের হিসাব মতে, প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা খেলাপি। কিন্তু ব্যাংক মালিকরা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে নামে-বেনামে যে টাকা ব্যাংক থেকে বের করে নিয়ে গেছেন, সেই অর্থ এর সাথে যুক্ত হলে দেখা যাবে ব্যাংক খাতের অর্ধেক ঋণই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে সার্বিকভাবে আর্থিক খাত ভেঙে পড়তে পারে। এ আশঙ্কার বিষয়টি সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাৎকারে স্পষ্টত প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমার উল্লেখযোগ্য সফলতা হলো- এখন আর বাংলাদেশে কেউ না খেয়ে মরে না। দারিদ্র্যবিমোচন লক্ষ্য ছিল, তা একটি পর্যায়ে চলে এসেছে- এটাই বড় সফলতা। তবে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অরাজকতায় ব্যবস্থা না নেয়াটা ভুল ছিল, ব্যর্থতা নয়।... ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থায় নেই, সেটা সত্য। খেলাপি ঋণই বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। এটা বছরের পর বছর চলছে। খেলাপি ঋণ কমাতে এখনই উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা নেয়া উচিত। এ অবস্থার জন্য দায়ী আসলে আমরা সবাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোক্তা ছিল না। যারা সুবিধা নিয়েছে, তারা কখনোই উদ্যোক্তা ছিল না। তারা লুটপাট করতে এসেছিল। লুটপাট করে চলে গেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য- সেটা বুঝেও বারবার তাদের সুবিধা দিয়ে গেছি। এজন্য আমিও কিছুটা দায়ী। এসব ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল আমার। আমি পারিনি। কারণ, আমার ভয়ঙ্কর রকমের ভয় ছিল। একটি ব্যাংক বন্ধ করে দিলে দেশের জন্য খুব ক্ষতিকর হতো বলে মনে হয়েছিল। নিজের একটা অভিজ্ঞতা ছিল। ১৯৪৮-৪৯ সালে কমরেড ব্যাংক দেউলিয়া হয়, ওই সময়ে আমি ছাত্র। বৃত্তির টাকা থেকে সাইকেল কেনার জন্য আমার জমানো ১৪০ টাকা আর ফেরত পাইনি। খুব কষ্ট হয়েছিল। সেই অনুভূতি থেকেই ব্যাংক বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। সেটা আমার ভুল ছিল।
যেমন- ফারমার্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল চোর ব্যাংক হিসেবে। যারা চোর ছিল, তারা প্রথমেই সব নিয়ে চলে গেছে। তারা কোনোভাবেই অভিযুক্ত হয়নি, খুব চালাকি করেছে। এই ব্যাংক বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, সেটা ভুল হয়েছে। কারণ, দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এখন এই পর্যায়ে নেই যে একটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে অর্থনীতিতে ধস নামবে। এটা আসলে আমারই ভুল হয়েছে।... অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট দমনে আমি কিছুই করতে পারিনি। ভেবেছিলাম, অবসরে যাওয়ার আগে একটি পরিকল্পনা দিয়ে যাবো; কিন্তু সেটাও পারিনি। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ১০ বছরে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এমন একটি স্থানে নিয়ে গিয়েছিলাম- এসব লুটপাট, দুর্নীতি বন্ধ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। কারণ, যে জেনারেশন ঘুষে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেই জেনারেশন কোনোভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আমার পরবর্তী সময়ে যারা অর্থ মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন তাদের ওপর ছেড়ে দিয়েই অবসর নিয়েছিলাম।’
জনাব মুহিতের এই উপলব্ধি দায়িত্বে থাকার সময় হলে ভালো হতো। তার মতে, ‘অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে এখনো। অর্থনীতির উন্নয়ন অগ্রযাত্রা হয়তো আরো দুই বছর থাকবে। কিন্তু এরপর কী হবে, সেটা বলা মুশকিল।’ কয়েক সপ্তাহ আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী এই সাক্ষাৎকার যখন দেন তখনো করোনা আঘাত করেনি। তার দুই বছর সময় সম্ভবত এখন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। অর্থনীতির মূল ভিত্তিমূল আর্থিক খাত। এই খাতের অবস্থা নীতিনির্ধারকদের অজানা নয় বলে তারা ব্যাংক অবসায়ন ও একীভূতকরণের আইন ও বিধিবিধান তৈরি করছেন। এ ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ না নিলে শুধু আর্থিক খাতই নয়, অর্থনীতির ভিত্তিমূলই ধসে যেতে পারে। বাজেট তৈরির এই সময়ে অর্থনীতির মুদ্রা ও রাজস্ব খাতের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য তথ্য-উপাত্ত সামনে রাখা হলে এ সত্য এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। সময় থাকতে ব্যবস্থা না নিয়ে কেবল কথামালা দিয়ে অর্থনীতির বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। এই উপলব্ধি সর্বোচ্চ পর্যায়ে কবে হবে কে জানে?
mrkmmb@gmail.com