মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের ভেল্কি

আবদুল্লাহ আবরার | Mar 11, 2020 03:17 pm
মুহিউদ্দিন ইয়াসিন

মুহিউদ্দিন ইয়াসিন - ছবি : সংগ্রহ

 

মালয়েশিয়ায় ষাট বছর ক্ষমতায় থাকা একটি দলকে নির্বাচনে হটিয়ে সরকার গঠনের ঘটনাকে বলা হচ্ছিল অভূতপূর্ব এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই নতুন সেই জোট সরকারের পতন হলো এবং পুরনো দলটি আবার ক্ষমতাসীন। মাহাথিরের পদত্যাগের কারণে দেশটি এখন রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে পড়েছে।

বেশ কয়েক সপ্তাহজুড়ে অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক অঙ্গনে টালমাটাল অবস্থার পর মালয়েশিয়ায় নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। রাজনীতিতে তার যাত্রা ছিল সাধাসাধি। ২০১৬ সালে ক্ষমতা হারানো ইউনাইটেড মালেজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা ইউএনএমও থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে।
এরপর তিনি মালয়েশিয়ার দীর্ঘ দিনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা মাহাথির মোহাম্মদ এবং আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে হাত মেলান। যার ফলে গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটা জাতিসত্তা ও দলের সংমিশ্রণে ‘পাকাতান হারাপান’ নামে একটি দল।
মালয়েশিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেসময় যে ব্যাপক জনরোষ তৈরি হয়েছিল, সেটি তারা কাজে লাগিয়েছিলেন। ইউএনএমও’র নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আসীন বারিসান ন্যাশনাল জোটের পতন ঘটিয়ে দেন তারা। কিন্তু রাজনীতি উত্থান, পতন, মারপ্যাঁচের খেলা।

গত কয়েক সপ্তাহে সেই খেলা বেশ ভালোই দেখিয়েছেন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। ৩০ জন এমপি নিয়ে সরকার থেকে বের হয়ে যান এবং তার পুরনো দলের সাথে জোট গড়ে তুলে পুরোপুরি পটপরিবর্তন করে দেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক রূপান্তরের মাধ্যমে দেশটিতে যে নবযুগের সূচনা হয়েছিল, মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের দাবার ঘুঁটির চাল তা চুরমার করে দেয়।
‘আমি ব্যর্থতার জন্য আমি দুঃখিত। আমি চেষ্টা করেছি, আমি সত্যিই ওদের থামাতে চেষ্টা করেছি’, এক টুইট বার্তায় লিখেছিলেন সাঈদ সাদিক, তরুণ রাজনৈতিক যিনি ২০১৮ সালে নির্বাচনে জিতে সবাইতে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে বলা হচ্ছিল পরিবর্তনের প্রতীক।

মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের দলের সদস্য সাঈদ সাদিক এখন তার সাথে আবার যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। মুহিউদ্দিন ইয়াসিন যেভাবে সরকার গঠন করেছেন তাকে পেছনের দরজার কারসাজি বলে সমালোচনা করে তার সরকারকে আখ্যা দেয়া হচ্ছে ‘ব্যাকডোর গভর্নমেন্ট ’।

আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট ফাদিয়া নাদওয়া বলেন, ‘পুরো বিশ্বাসঘাতকতা।’ বলা হচ্ছিল ‘পাকাতান হারাপান’ এক অনন্য জোট যাতে ছিল আনোয়ার ইব্রাহিমের সংস্কারপন্থী দল কিদালিন, মালয়েশিয়ার চীনা জাতিগোষ্ঠীর দল দ্যা ড্যাপ এবং ইউএনএমও বিরোধী দু’টি মালে জাতিগোষ্ঠীর দল আমানাহ এবং বারসাতু। শেষ দলটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ মাহাথির মুহাম্মদ। তার পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ক্ষমতাসীন দলকে বর্জনের শক্তি পেয়েছিল মালে জাতিগোষ্ঠী। মালয়েশিয়ার সুশীল সমাজের গঠিত বেশ কিছু সংস্থার সমর্থনও পেয়েছিল ‘পাকাতান হারাপান’।
মালয়েশিয়ার ইউএনএমও দলের দীর্ঘ ষাট বছরের ক্ষমতাকালীন দেশটিতে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিপক্ষে ছিলেন সেখানকার সুশীলসমাজ। কিন্তু ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত কেউই নিশ্চিত ছিলেন না যে ‘বারিসান’ জোটকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে।
তবে এক ধরনের উত্তেজনার পরিবেশ অনুভূত হচ্ছিল। মাহাথির মোহাম্মদ তার প্রচারণায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও তার স্ত্রী রোজমাহকে রীতিমতো ‘চোর জুটি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

দেশটিতে জীবনধারণের খরচ বৃদ্ধি পাওয়া বিশেষ করে পণ্য বিক্রির ওপর একটি বিশেষ কর আরোপ করার বিষয়টি বিরোধীরা খুব ব্যবহার করেছেন। সাধারণত সরকারপন্থী মালে জাতিগোষ্ঠীর ভোট পাকাতান, বারিসান ও ইসলামিক পার্টির মধ্যে তিন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল।

ভোটকেন্দ্রে তখন অনেকেই ইউএমএনও দলের কার্ড দেখালেও তারা বিরোধীদের ভোট দেবে জানাচ্ছিল। পরদিন নাজিব রাজাক যখন হারলেন তখন আনন্দমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তিনি তার দলের হেরে যাওয়া প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী।
পাকাতান জোটের যাত্রা যে কিছুটা অস্বস্তির হবে সেটি বোঝাই যাচ্ছিল। বিশেষ করে মাহাথির মোহাম্মদ এবং আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে ৩০ বছরের একটি জটিল ইতিহাস রয়েছে। আনোয়ার ইব্রাহিম একসময় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদের শিষ্য।

মনে করা হতো তিনিই হবেন মাহাথির মোহাম্মদের উত্তরসূরি। কিন্তু আনোয়ার ইব্রাহিম তার পাঁচ বছরের কারাবাসের জন্য মাহাথির মোহাম্মদকে দায়ী করে থাকেন।
কিন্তু পাকাতান জোটের জন্য তারা দু’জন বিভেদ ভুলে আবার একত্র হন। তারা একমত হন যে মাহাথির মোহাম্মদ নির্বাচনী প্রচারণার নেতৃত্ব দেবেন, জয়ী হলে প্রথম দুই বছর প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকবেন এবং তারপর আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় সেটি হবে সে নিয়ে কথাবার্তা হয়নি। একই সাথে দেশটিতে চলমান বৈরী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেয়া হবে পাকাতান জোটে তা নিয়ে তাদের মতবিভেদ ছিল।

‘অনেক দেশের মতো আমাদের মধ্যেও এক ধরনের অসন্তোষের সমস্যা রয়েছে,’ বলছিলেন মারদেকা সেন্টার ফর অপিনিয়ন রিসার্চ সংস্থার ইব্রাহিম সুফিয়ান।
‘আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আছে কিন্তু জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বাড়েনি। বিশেষ করে মালে জনগোষ্ঠী ও তরুণ প্রজন্মের’, তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন।
‘আবার ভালো বেতন মেলে যথেষ্ট পরিমাণে তেমন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছিল না। জোটের সামনে সেটি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। তারা যখন ক্ষমতা নেয় তখন তারা আবিষ্কার করে যেসব তহবিল শূন্য এবং তাদের বিশাল অংকের ঋণের বোঝা টানতে হবে।’

১৯৫৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে মালয়েশিয়াকে সবসময় বলা হয়ে থাকে নানা জাতিসত্তার দেশ। মালে উপদ্বীপ ও বোর্নিও অঞ্চলের কয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠী আর মালে জাতিগোষ্ঠীকে বলা হয় ‘বুমিপুতেরা’ যারা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ।
সংখ্যালঘুদের মধ্যে সবচেয়ে সফল হচ্ছে ব্রিটিশ আমলে মালয়েশিয়ায় আসা চীনা বংশোদ্ভূতরা। ১৯৬৯ সালে এক দাঙ্গার পর তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে রাষ্ট্রীয় নীতিমালাগুলো ‘বুমিপুতেরা’ বিশেষ করে মালে সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতমূলক হওয়া জরুরি।

ইউএমএনও দলটি মালে জাতিগোষ্ঠীর অভিভাবক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। চীনাদের তুলনায় মালে জাতিগোষ্ঠী ছিল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশক পর্যন্ত মাহাথির মুহাম্মদের ২২ বছরের শাসনকালে এই নীতির ব্যত্যয় হয়নি।

তাদের জন্য হাতে নেয়া হয়েছিল বড় তহবিলের নানা রকম রফতানিমুখী প্রকল্প। কিন্তু বড় সমস্যা ছিল স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি। কিন্তু মালেরা তাদের প্রতি সরকারি উদারতা চলমান থাকবে বলে আশা করে আসছিল।

বেশ ভালো চীনা অংশীদারিত্ব সম্বলিত পাকাতান জোট হয়তো সেই উদারতায় রাশ টেনে ধরতে পারে তেমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল মালেদের মধ্যে। তাই পাকাতানদের প্রতি তাদের সমর্থনেও ক্ষয়ের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল।
যদিও বিশাল অঙ্কের অর্থ তহবিল এধার ওধার হওয়ার খবরে ইউএমএনও’র সুখ্যাতি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে অর্থের একটি অংশের গন্তব্য ছিল নাজিব রাজাকের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।

কিন্তু পাকাতান সম্পর্কে মালেদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হচ্ছিল আর অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টি কাজে লাগাতে মোটেও দেরি করেননি ইউএমএনও। পাকাতান ইতিমধ্যেই জোহর অঞ্চলে ছয়টি উপ-নির্বাচনের পাঁচটিতেই হেরেছে।
তবে সঙ্কট শুরু হয় ক্ষমতার উত্তরাধিকার নিয়ে। মাহাথির মোহাম্মদের প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে আনোয়ার ইব্রাহিমের সমর্থকেরা উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার দাবি জানান।

মাহাথির মোহাম্মদ তাতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে অবশ্য আনোয়ারের সমর্থকেরা পিছু হটেন। কিন্তু পাকাকান জোটের মধ্যে বিভেদ ও উত্তেজনা বাড়তে থাকায় একপর্যায়ে মুহিউদ্দিন ইয়াসিন ৩০ জন এমপি নিয়ে জোট সরকার থেকে বের হয়ে আবার পুরনো দলে যোগ দেন।

গত চল্লিশ বছর ধরে মানুষজন যেভাবে ভেবেছে, এবারো অনেকে মনে করেছে মাহাথির মোহাম্মদই পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। কিন্তু তিনি নিজের পদত্যাগের কথা জানিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে দেন।

মাহাথির মোহাম্মদের প্রতি যদিও অনেকে সমর্থন দিয়েছেন এমনকি আনোয়ার ইব্রাহিমও। তবে মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের ভূমিকাকে তিনি জোটের মধ্যে অভ্যুত্থান বলে আখ্যা দেন। তবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে ৯৪ বছর বয়সী ঝানু রাজনীতিবিদ মাহাথির মোহাম্মদ হিসেবে কিছু গোলমাল করেছেন।
সাংবিধানিক দায়িত্ব বলে মালয়েশিয়ার বাদশাহ আবদুল্লাহ মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানান। এর পরই মুহিউদ্দিন ইয়াসিন দেশটির অষ্টম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

মাহাথির মোহাম্মদ এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরবর্তী সংসদ অধিবেশন শুরু হলে নতুন সরকারের পতনের জন্য কাজ করবেন। কিন্তু রাজপ্রাসাদের সমর্থন মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের জন্য এখন বড় আশীর্বাদ।

অন্য দিকে মাহাথির মোহাম্মদের সাথে মালয়েশিয়ার সুলতানদের বিবাদের ইতিহাস রয়েছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাদশাহ আবদুল্লাহর বাবার সময়ে মাহাথির মোহাম্মদ রাজপরিবারের ক্ষমতা সীমিত করার সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন, বলছিলেন নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইভ কেসলার।
হয়তো বাদশাহ আবদুল্লাহর সিদ্ধান্ত সে কারণেই মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পক্ষে প্রভাবিত হয়েছে। অবশ্য রাজকীয় অভ্যুত্থানের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাজা। মালয়েশিয়ার প্রাসাদ থেকে বলা হয়েছে, রাজা সংবিধান নির্ধারিত তার বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন।

সব মিলিয়ে দুই বছর পর মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের সাথে হাত মিলিয়ে আবারো ক্ষমতায় ইউনাইটেড মালেজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন। আনোয়ার ইব্রাহিমের যেমন আবারো আশাভঙ্গ হলো, তেমনি মাহাথির মোহাম্মদের সামনেও আর কোনো রাস্তা খোলা আছে বলে মনে হচ্ছে না।

মাহাথির পার্লামেন্টে মুহিউদ্দিনকে চ্যালেঞ্জ করবেন বলে জানানোর পর মালয়েশিয়ায় পার্লামেন্ট অধিবেশন দুই মাস পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে মুহিউদ্দিন আগামী সপ্তাহে তার মন্ত্রিসভা ঘোষণা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। মাহাথির আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করার পর ক্ষমতাসীন জোট ভেঙে যাওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্ভাবনাময় এই দেশটি নতুন করে রাজনৈতিক ধূম্রজালে পড়ে গেল। এখন অপেক্ষা করতে হবে মুহিউদ্দিন কতদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন। পর্যবেক্ষণ মহল মনে করে, তার ক্ষমতা বেশি দিন স্থায়ী নাও হতে পারে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us