মুসলিম জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা
আল আকসা মসজিদ - ছবি : সংগ্রহ
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ইসরাইল কর্তৃক পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে অগ্নিসংযোগের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৯ সালের ২২-২৬ সেপ্টেম্বরে ২৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের নেতারা মরক্কোর রাজধানী রাবাতে মিলিত হন এবং ২৫ সেপ্টেম্বর ‘ওআইসি চার্টার’ গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) গঠন করেন। বর্তমানে এর নাম ‘ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা’। ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র ওআইসির সদস্য। এটি এখন মুসলমানদের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংগঠন। এটিকে বলা যায় ‘মুসলিম জাতিসঙ্ঘ।’ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজ নিজ সরকার ওআইসিতে তাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। তিন বছর পরপর এর শীর্ষ সম্মেলন এবং প্রতি বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সব সম্মেলনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মহাসচিবের পরিচালনায় সংস্থার স্থায়ী সচিবালয় আছে। ওআইসির কার্যপরিধি বাড়িয়ে এবং একে অধিকতর শক্তিশালী করে মুসলিম বিশ্ব ঐক্যের পথে আরো এগিয়ে যেতে পারে। ওআইসিকে আরো কার্যকর ও শক্তিশালী করতে এর বিভিন্ন কমিটিতে সরকারি ছাড়াও বেসরকারি পর্যায় থেকেও ইসলামী চিন্তাবিদদের আরো ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। সদস্য রাষ্ট্রের সরকারগুলোকে এ বিষয়ে আরো আগ্রহী ও মনোযোগী হতে হবে।
ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওআইসির সম্মিলিত ভূমিকা পালনে চেষ্টা করা উচিত। ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পদের সহজ প্রবাহ, অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোকে সাহায্য দান এবং ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে চেষ্টা চালানো উচিত। ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেয়া ইসলামের নির্দেশ। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে পৃথিবীর দরিদ্র এলাকাগুলোতে দরিদ্রপীড়িত জনগণের ক্ষুধা নিবারণসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ওআইসির প্রচেষ্টা চালানো উচিত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্র বিরোধ কিংবা যেকোনো দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত নিরসনে এবং যেকোনো সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার সংরক্ষণে ওআইসির ভূমিকা পালন করাই প্রত্যাশিত।
বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যে সব দ্বন্দ্ব বিরোধ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ বিদ্যমান তা নিরসনের জন্য বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা চালানো কর্তব্য; এটি কুরআনের নির্দেশ, ঈমানী দায়িত্ব। এসব দায়িত্ব পালনের জন্য ওআইসি সচিবালয়ের আওতায় একটি স্থায়ী মধ্যস্থতাকারী সেল গঠন করা যেতে পারে। বিভিন্ন মুসলিম দেশের সরকারি ও বেসরকারি ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম, উম্মাহর কল্যাণকামী অভিজ্ঞ কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে উক্ত এই সেল গঠন করা যেতে পারে। যেকোনো দেশে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত দেখা দিলে এই সেল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম হওয়া সত্ত্বেও কুরআন ও হাদিসের নির্দেশ অনুসরণের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ গঠনে দায়িত্ব পালন করতে পারে। এ দায়িত্ব পালন ঈমানী দায়িত্বের অংশ। ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (সূরা হজুরাত, আয়াত-১০)। অতএব, প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র পরস্পরের ভাই। এক মুসলিম ভাই (রাষ্ট্র) অপর কোনো ভাইয়ের বিরুদ্ধে যাবে না, ক্ষতি করবে না এবং দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে লিপ্ত হবে না। প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র পরস্পরের বন্ধু হবে এবং একে অপরের কল্যাণকামী হবে। এর মাধ্যমে তাদের ঈমানী দায়িত্ব পালন করা হবে এবং উম্মাহও ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের সরকারকে তার নাগরিকদের কল্যাণের জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকারকে কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত নির্দেশাবলির আলোকে তার জনগণের সাথে মানবিক আচরণ ও দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরস্পর কল্যাণকামিতার মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব জাগ্রত রাখতে হবে এবং কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রতি প্রতিহিংসা বা শত্রুতামূলক আচরণ পরিহার করে চলতে হবে। জাতীয় ঐক্যের জন্য প্রয়োজন দেশের জনগণের কল্যাণ ও মতামতকে গুরুত্ব দেয়া এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। যে সব দেশ গণতন্ত্রকে সাংবিধানিকভাবে গ্রহণ করেছে সেসব দেশে ক্ষমতার পালাবদলের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো অভ্যন্তরীণ অনেক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।
বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক, কোনো মুসলিম ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী নির্যাতিত হলে তাদের নির্যাতন থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা অপর মুসলমানের দায়িত্ব। রাসূল সা: বলেছেন : মুমিনরা একটি দেহের মতো। দেহের যে অঙ্গেই ব্যথা হোক না কেন তাতে সম্পূর্ণ দেহ ব্যথা অনুভব করে, জ্বর ও অনিদ্রায় ভুগতে থাকে (বুখারি ৬০১১, মুসলিম ২৫৮৬)।
আজকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন শক্তির দিয়ে আক্রান্ত এবং নির্যাতিত। মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নির্মূল অভিযান চালিয়ে ১২ লাখ মুসলমানকে তাদের ঘরবাড়ি ও দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে এবং তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পাশ্চাত্য শক্তি ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইহুদিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তখন থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চরম নির্যাতন চালিয়ে আসছে। গত ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি সৈন্যের কামান বোমা কিংবা গুলিতে ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নরনারী-শিশু, যুবক-বৃদ্ধ ইসরাইলের হাতে খুন হয়েছেন। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় শিবিরে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছেন। যারা দেশে আছেন, তারা নিজ ভূমিতে পরাধীন জীবনযাপন এবং প্রতিদিন ট্যাংক-সাঁজোয়া কিংবা কামান গোলার গুলির মধ্যে কেউ না কেউ শাহাদাত বরণ করছেন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সচিব, বাংলাদেশ সরকার