কিডনি রোগ প্রতিরোধে ১১ সতর্কতা
কিডনি রোগ প্রতিরোধে ১১ পদক্ষেপ - ছবি : সংগ্রহ
কিডনি জটিলতা এখন বিশ্বজুড়েই একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। বিশ্বের সকল জনগোষ্ঠির প্রতি ১০ জনের ০১ জন কিডনি রোগে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিডনি রোগ মানব জাতির পঞ্চম মৃত্যুর কারণ এবং স্বাস্থ্য খাতের ২ থেকে ৩ শতাংশ বরাদ্দ এই কিডনি রোগের জন্য ব্যয় হয়ে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে- নিম্ন আয়ের দেশে শতকরা ৮০ ভাগ কিডনি রোগি কিডনি ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন থেকে বঞ্চিত। কিডনি রোগের উৎপত্তি ও এর ক্রমাগত কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া প্রায় ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় রোধ করা যেতে পারে।
প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্য খাতে কিডনি রোগের ভয়াবহতা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। কিডনি অকেজো রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল যা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের বাজেটে প্রায় শতকরা ৩ ভাগ কিডনি রোগের চিকিৎসা, ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন ক্ষেত্রে ব্যয় হয়। কাজেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ সনাক্ত করা; যাতে কিডনি রোগ না হতে পারে সেই উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রতি বছর কিডনি দিবস পালন করা হয়। প্রতিরোধের জন্য তিনটি স্তরে কিডনি রোগ না হওয়ার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। প্রথম স্তরে প্রাথমিকভাবে কিডনি রোগের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলির উপর নজর দিতে হয় এবং কিডনি ও মূত্রনালী, মূত্রথলি ও প্রস্রাবের রাস্তার কাঠামোগত ক্রুটি চিকিৎসা করা এবং সর্বোপরি কিডনি ক্ষতিকারক কোনো ওষুধ ও পরিবেশের কোনো রাসায়নিক পদার্থ থেকে বিরত থাকতে হবে।
দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ কিডনি রোগের প্রধান দুটি কারণ ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্তনে রাখতে হবে। তৃতীয় স্তর অর্র্থাৎ যারা ধীর গতির কিডনি রোগের চিকিৎসায় আছেন এবং শতকরা ৬০ থেকে ৭০% কিডনি কাজ করছে না; তাদের ক্ষেত্রে কিডনি অকেজো রোগের জটিলতা বিশেষ করে হৃদপি- ও মস্তিস্কের জটিলতা থেকে প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই ব্যবস্থার ফলে এই সকল রোগিদের ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজনের সময় বিলম্ব হয়। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার গুরুত্ব অত্যাধিক। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনো ধরনের কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে ধীর গতিতে আক্রান্ত কিডনি রোগীরা কোনো দিন কিডনি কার্যক্ষমতা ফিরে পায় না বরং ধীরে ধীরে সময়ের ব্যবধানে কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় এবং এক পর্যায়ে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন স্তরে পৌঁছায়। তখন ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচানো যায় না।
আশার কথা হলো, কিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য যদি সঠিক সময়ে কিডনি রোগের সনাক্ত করা ও চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়। এই ক্ষেত্রে ওষুধের সাথে জীবনযাত্রার অভ্যাস ও খাদ্যের পুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে। বলা বাহুল্য কিডনি রোগের সনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও সেবাদান বিশ্বের সকল দেশে সমমানের নয়। স্বল্প উন্নয়ন দেশে এই সেবাদানের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।
একটি কথা বলতেই হয় তা হলো জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রদত্ত টেকসই উন্নয়ন বা এসডিজিএস-এ কোন রোগির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয় নাই। বর্তমানে অসংক্রামক রোগের মধ্যে হার্ট ও মস্তিস্কের রোগ, ক্যান্সার, ডায়ারেটিস ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ অর্ন্তভূক্ত করা হলেও কিডনি রোগকে অর্ন্তভূক্ত করা হয় নাই। অতএব কিডনি রোগকে আর্ন্তজাতিক ও রাজনৈতিকভাবে সুনজর ও অত্যাবশ্যক জরুরি রোগ হিসাবে মূল্যায়ন করা উচিত। কারণ কিডনি রোগ বিশ্বের একটি অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা। কিডনি রোগ শুধু হার্ট ও মস্তিস্কের রোগের ঝুঁকি বহন করে না, এটি শরীরে ইনফেকশন ও টিবি রোগের ঝুঁকি বহন করে। কাজেই বাস্তব অবস্থা প্রেক্ষাপটে কিডনি রোগকে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনায় অর্ন্তভূক্ত করন ও কিডনি রোগের সনাক্তকরণ এবং এই ব্যাপারে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
কিডনি রোগের প্রতিরোধকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন-প্রাথমিক প্রতিরোধ অর্থাৎ রোগ হওয়ার আগে ব্যবস্থা নেয়া যাতে রোগী রোগে আক্রান্ত না হয়। দ্বিতীয় বা সেকেন্ডারি প্রতিরোধ অর্থাৎ রোগকে প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ ও রোগের প্রথম অবস্থায় চিকিৎসা করা। তৃতীয় ধাপ বা টারশিয়ারি প্রতিরোধ হলো যখন রোগী কিডনি রোগে আক্রান্ত সেই ক্ষেত্রে কিডনি রোগের জটিলতা থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য চিকিৎসা প্রদান।
প্রাথমিক প্রতিরোধ : কিডনি রোগের প্রথম দুটি কারণ হচ্ছে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দিক হচ্ছে- শরীরের স্থুলতা, খাদ্যে অতিরিক্ত আমিষ, মূত্রনালী ও প্রোস্টেটের গঠনতন্ত্রের ক্রুটি, কিডনির ছাকনির প্রদাহ (নেফ্রাইটিস) ও বেদনানাশক ওষুধ সেবন, কিডনির ক্ষতিকারক খনিজ পদার্থ, ক্যান্সারের জন্য ঔষধের ব্যবহার, শরীরের পানি শূণ্যতা এবং উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবের জন্য কিডনির ক্ষতি হয়। এছাড়া কীটপতঙ্গের জন্য ব্যবহৃত ঔষধের দ্বারা কিডনির ক্ষতি হয়ে থাকে। বয়সজনিত কারণে, জেনেটিক ও পরিবেশের কারণে কিডনি রোগ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় হার্টের রোগ এবং লিভার রোগের জন্যও কিডনি রোগ হয়ে থাকতে পারে।
সেকেন্ডারি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কিডনি রোগের প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে রোগির সংখ্যা বেশি। এই ক্ষেত্রে প্রস্রাবে মাইক্রো এ্যালবুমিনিউরিয়া ৩০ থেকে ৩০০ মিঃ লিঃ গ্রাম পর্যন্ত নির্গত হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে প্রথমে রক্তচাপ ও ডায়বেটিস সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
কিডনি অকেজো রোগীর ক্ষেত্রে তৃতীয় স্তরে মানে টারশিয়ারি প্রতিরোধের মধ্যে রক্ত শূন্যতা, খনিজ পদার্থের দুর্বলতা সর্বোপরি হার্ট ও মস্তিষ্কের রোগের প্রতিরোধকে বুঝায়। কিডনি রোগীদের এই স্তরে হার্ট ও মস্তিস্কের রোগের জন্য বেশিরভাগ রোগি মৃত্যুবরণ করে। কিডনি রোগিরা এই দুইটি রোগের জন্য অন্যান্য ঝুঁকি অর্থাৎ স্থুলতা ও রক্তের অতিরিক্ত মাত্রায় চর্বির ঝুঁকি বিশেষ গুরুত্ব রাখে না। কিডনি রোগ নির্ণয়ের জন্য দুইটি পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এর মধ্যে একটি প্রস্রাবের মধ্যে প্রোটিন বা অ্যালবুমিন নির্গত হওয়া এবং দ্বিতীয়টি রক্তের সেরাম ক্রিয়েটিনিন ও একই সাথে ঊংঃরসধঃবফ এষড়সবৎঁষধৎ ঋরষঃৎধঃরড়হ জধঃব (বএঋজ) পরীক্ষা করাই যথেষ্ট। যারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বংশগত কিডনি রোগ, কিডনির ক্ষতিকারক ওষুধ ও হারবাল ওষুধ, নেশার জন্য ওষুধ, স্থানীয় কবিরাজি ওষুধ গ্রহণ করে এবং যাদের স্বাস্থ্য ইতিহাসে আকর্ষিত কিডনি অকেজো হয়েছিল এবং যাদের বয়স ৬৫ বছরের উর্ধ্বে এই সব লোককে কিডনি রোগের পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। এছাড়াও অন্যান্য ঝুঁকি অর্থাৎ কম ওজনের নবজাতক শিশু, ধুমপায়ী, বিভিন্ন রকমের শরীরে প্রদাহ কিডনি রোগের ঝুঁকি বহন করে।
কিডনি রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
একজন সচেন মানুষ হিসেবে আপনাকে কিডনি রোগ প্রতিরোধে কিছু নিয়ম মানতে হবে এব জানতে হবে। যেমন-
১। ডায়াবেটিস নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ
২। উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ
৩। শরীরের স্থুলতা কমানো
৪। নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করা
৫। টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ
৬। খাদ্যে অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করা
৭। সঠিক পরিমাণে পানি পান করা
৮। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন না করা
৯। বেদনানাশক ও ক্ষতিকারক ওষুধ পরিহার করা
১০। ধূমপান ও মধ্যপান থেকে বিরত থাকা
১১। সর্বপোরি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
লেখক : সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক, কিডনি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটউড অব কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজি