করোনায় লণ্ডভণ্ড বিশ্ব
করোনায় লণ্ডভণ্ড বিশ্ব - সংগৃহীত
করোনা ভাইরাসের কারণে ২০০৮ সালের পর বিশ্ব স্টক মার্কেট সবচেয়ে ভয়াবহ পতনের মুখে পড়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের দরপতন ঘটেছে শেয়ারের। বাজার বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ঝাঁকুনি দিতে পারে। যেখান থেকে এ ভাইরাসটির উৎপত্তি, চীনের সেই হুবেই প্রদেশ গাড়ি, ইলেকট্রনিকস, বিমানের সরঞ্জাম, প্রতিরক্ষা ও নির্মাণ ব্যবসার বড় কেন্দ্র। কিন্তু এই ভাইরাসের ক্ষতি এখন হুবেই ছাড়িয়ে বহুদূর প্রসারিত। মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গাড়ি কোম্পানি ও এয়ারলাইনসগুলোর ব্যবসার অনেকটা পতন হয়েছে।
উৎপাদনের সময় শিল্পের সব শাখায় যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে, সেই উৎপাদনের উপায় হিসেবে বিবেচিত যন্ত্রের ভাণ্ডার সবসময়ে সীমাবদ্ধ থাকে। এই বিষয়টিই নির্ভরযোগ্য সরবরাহের উপর ভিত্তি করে সঙ্ঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক শিল্পের পূর্বানুমানকে নিশ্চিত করে। এখন সেই পূর্ব অনুমিত সাপ্লাই চেনের বিষয়টি বিপদের মধ্যে পড়েছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আগে যে সংক্রমণটি বেশি আলোচিত হয়েছিল, সেই সার্সের সময় অর্থাৎ ২০০৩ সালে চীন আজকের মতো বিশ্বে এত গুরত্বপূর্ণ ছিল না। তখন চীন বিশ্ব অর্থনীতির মাত্র ৪ শতাংশ ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে দেশটি ১৫ শতাংশে পরিণত হয়েছে। ফলে নতুন ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব পড়বে। মনোপোলাইজেশনের অর্থই হলো অধিকাংশ ব্র্যান্ডের ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় উপাদান মাঝে মাঝে একটিমাত্র কারখানায় উৎপাদিত হয়। ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের বিপর্যয়ের পর গাড়ি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত নির্দিষ্ট একটি রঞ্জক পদার্থের ঘাটতির কারণে বিভিন্ন কারখানায় গাড়ি উৎপাদন থমকে গিয়েছিল। এখন, একই প্রক্রিয়া ঘটতে চলেছে। সকলেই নিশ্চিত, করোনা ভাইরাসের কারণে গাড়িশিল্পে কঠিন আঘাত আসছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি উৎপাদকরা হুবেই-এর কারখানার উপর নির্ভর করত এবং তারা এখন তাদের উৎপাদন অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ফিয়াট ক্রাইসলার, বিএমডব্লিউ ও পেউগিয়টের মতো ইউরোপীয় উৎপাদকরা উত্তর ইতালির সংক্রমণের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ, এই গাড়ি উৎপাদনের একটি উপাদান এই অঞ্চলের গ্রামগুলোতে প্রস্তুত হতো। ইউরোপীয় উৎপাদনের এই ঘাটতি ততক্ষণ পর্যন্ত পূরণ হচ্ছে না, যতক্ষণ না আগামী মাসে চার-পাঁচ সপ্তাহ ধরে চীন থেকে শিপমেন্ট না আসবে।
শিপিং হলো আরেকটি শিল্প, যেটি এখন মন্দার মুখে। ২০০৯ সালের পর গত বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সবচেয়ে বাজে সময় কাটিয়েছে। এর কারণ হিসেবে ট্রাম্পের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ এবং শ্লথগতির ইউরোপীয় অর্থনীতিকে দায়ী করা হচ্ছে। এই বছর আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে সম্পাদিত নতুন চুক্তির ফলে শিপিং ব্যবসায় ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু করোনা ভাইরাস আবার এই ব্যবসাকে বিপদে ফেলেছে। বড় কোম্পানিগুলো হয়তো ঘাটতি পুষিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে, তবে ছোট কোম্পানিগুলো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। কতগুলো শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, তা নির্ভর করছে এই ভাইরাসের ভয়াবহতা কতদিন টিকে থাকবে, তার উপর।
সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে পর্যটনশিল্পেও। চীনা পর্যটকরা সংখ্যায় বিপুল না হলেও তারা এই শিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগকারী। ২০১৮ সালে তারা বিশ্ব পর্যটনশিল্পের ২০ শতাংশ অর্থাৎ ২৭৭.৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা মার্কিন পর্যটকদের প্রায় দ্বিগুণ। জাপানে করোনা ভাইরাসের কারণে হোটেল ব্যবসায় প্রথম দেউলিয়া অবস্থা হয়েছে। এই ভয় এত পরিমাণ বাড়ছে যে মানুষ এখন ভ্রমণ এবং হলিডেতে হোটেল বুকিং বাতিল করছে। যদি উত্তর গোলার্ধের দেশগুলো এই ভাইরাসকে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে পর্যটনশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এর ফলে শুধু এই শিল্পেই ক্ষতিসাধন হচ্ছে তা নয়, এর সঙ্গে যুক্ত এয়ারলাইনসের ব্যবসাও আক্রান্ত হচ্ছে। শুনলে অবাক হবেন, হংকংয়ের ক্যাথি প্যাসিফিকের মতো হোটেল তাদের কর্মচারীদের বিনা বেতনে তিন সপ্তাহের ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
তবে, দুর্দশার সুযোগে কারো কারো মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়। আমেরিকায় সার্জিক্যাল এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক মাস্কের দাম তিনগুণ হয়েছে। আমাজনের মতো বহুজাতিক কোম্পানি তাদের সুনাম হারানোর ভয়ে বিক্রেতাদের বেশি দামে তাদের সরবরাহ করা মেডিক্যাল সামগ্রী বিক্রির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে।
হ্যান্ড-স্যানিটাইজারের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এই ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগে ব্যাপক মুনাফা করছে। তারা এর চিকিৎসা এবং প্রতিষেধক বাবদ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। জাপানের সরকার আভিগানের মতো ফ্লু-প্রতিষেধককে সুপারিশ করায় তাদের মালিক ফুজিফিল্মের শেয়ার ৮.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সুযোগে বড় কোম্পানিগুলো ছোট ছোট কোম্পানিকে গিলে খাচ্ছে।
সূত্র : বর্তমান