পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতে করোনার ছোবল

আশরাফুল ইসলাম | Mar 10, 2020 06:55 am
পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতে করোনার ছোবল

পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতে করোনার ছোবল - সংগৃহীত

 

করোনার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের প্রধান দুই খাত পুঁজিবাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। রোববার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন রোগী শনাক্ত হওয়ার পর গতকাল সোমবার দেশের প্রধান এই দু’টি খাতে বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে করোনার প্রভাবে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস নেমেছে। বলা যায়, গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থায় নেমে এসেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক। এক দিনে ২৭৯ পয়েন্ট হারিয়েছে ডিএসইর প্রধান সূচক। এ দিকে গতকাল ব্যাংকেও অন্য দিনের চেয়ে কম লেনদেন হয়েছে। বিশেষ করে কিছু ব্যাংকের শাখায় গ্রাহকসংখ্যা একেবারেই কম দেখা গেছে। নগদ লেনদেনের পরিবর্তে ইলেকট্রনিকস লেনদেন বিশেষ করে অনলাইন, এটিএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিং বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবিবি প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১০ সালের মহাধসের পর দেশের গতকালের মতো পুঁজিবাজারে এমন নাজুক অবস্থা আর দেখা যায়নি। গতকাল করোনাভাইরাস নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে দেশী-বিদেশী সব ধরনের বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়েছেন। যার ফলে শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। এর প্রভাবে গতকাল এক দিনেই ২৭৯ পয়েন্ট সূচক হারিয়েছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসই। গতকাল সোমবার লেনদেনের শুরু থেকেই সূচকের একটানা পতন লক্ষ করা যায়। প্রথম ৬ মিনিটের লেনদেনে ডিএসইর সূচক হারায় ১০০ পয়েন্ট। বেলা ১১টায় সূচকটি দেড় শ’ পয়েন্ট হারায়। বেলা ১১টা ১৬ মিনিটে উধাও হয় ২০০ পয়েন্ট। লেনদেন শেষে সূচক কমে যায় ২৭৯ পয়েন্ট। দিন শেষে সূচক দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮ পয়েন্টে। গতকাল মাত্র দু’টি কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ে। বাকি ৩৫২টি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে যায়। এ সময় একটির দাম অপরিবর্তিত থাকে।

ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট রাকিবুর রহমান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের আতঙ্কের প্রভাব আমাদের দেশে পড়েছে। বিশেষ করে যেসব শিল্প কলকারখানায় চীনের বিনিয়োগ ছিল বা চীনের কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল ছিল ওই সব প্রতিষ্ঠানে চীনের করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই সব প্রতিষ্ঠান। এরওপর নতুন করে দেশে তিনজন করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দেশের পুঁজিবাজারের ওপর প্রভাব পড়েছে। ডিএসইর সাবেক এ প্রেসিডেন্ট বলেন, গ্রাহক বারবার আস্থায় হোঁচট খাচ্ছেন। গত ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছিল। ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রত্যেকটি ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করতে বলা হয়েছিল। এ ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালা পাঁচ বছরের জন্য শিথিল করেছিল। ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করলে এরওপর কোনো প্রভিশন রাখতে হবে না। এটা বিদ্যমান বিনিয়োগসীমারও বাইরে রাখা হবে। আমরা আশা করছিলাম দেশের বিদ্যমান ব্যাংকগুলো ২০০ কোটি টাকা করে তহবিল গঠন করলে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন হবে। এতে পুঁজিবাজারের তারল্য সঙ্কট কেটে যাবে। কিন্তু মাত্র ২-৩টি ব্যাংক ছাড়া আর কোনো ব্যাংক এগিয়ে আসেনি। কেন এগিয়ে এলো না তারও কোনো জবাব নেই। এভাবেই বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বারবার হোঁচট খেয়েছে। তিনি মনে করেন, যত দিন পর্যন্ত ব্যাংক পরিচালকদের ব্যাংকিং খাত থেকে লুটপাট বন্ধ না হবে, যত দিন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হবে এবং যত দিন পর্যন্ত ব্যাংক খাত চাঙ্গা না হবে তত দিন পর্যন্ত পুঁজিবাজার চাঙ্গা হবে না।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব বিশ্বের সব স্টক এক্সচেঞ্জে পড়েছে। গতকাল গড়ে বিশ্বব্যাপী ৬ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সূচক কমেছে। শুধু ভারতেই গতকাল সূচক হারিয়েছে ১ হাজার ৯৪১ পয়েন্ট। আর পাকিস্তানের পুঁজিবাজারে সূচক হারিয়েছে ৬০০ পয়েন্ট। সেখানে আমাদের বাজার আকৃতি অনুযায়ী ২৭৯ পয়েন্ট সূচক হারিয়েছে। এটা নিঃসংন্দেহে বড় দরপতন। তবে, তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে করোনাভাইরাসের প্রভাবমুক্ত থাকার জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে। খুব শিগগিরই এ নেতিবাচক প্রভাব থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

এ দিকে করোনাভাইরাসের প্রভাব পুঁজিবাজারের মতো আর্থিক বাজারেরও ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। গতকাল রাজধানীতে বেশির ভাগ ব্যাংকের শাখায় লেনদেন অর্ধেকে নেমে এসেছে। একান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ লেনদেন করতে আসেনি। মতিঝিলে এ নিয়ে একটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, প্রতিদিনে যে হারে লেনদেন হয় গতকাল তা অর্ধেকের কম লেনদেন হয়েছে। গ্রাহক ছিল হাতেগোনা। অর্থ উত্তোলন ও জমা দুইটিই কম ছিল। তবে, অর্থ জমা দেয়ার চেয়ে তুলনামূলকভাবে অর্থ উত্তোলনই হয়েছে বেশি।

করোনাভাইরাস থেকে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতার সাথে লেনদেনের পরামর্শ দিয়েছেন ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) প্রেসিডেন্ট ও ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আলী রেজা ইফতেখার। করোনাভাইরাসের আতঙ্কের কারণে ব্যাংক লেনদেন কম হতে পারে। তবে, করোনাভাইস থেকে আতঙ্ক হওয়ার কোনো কারণ এখনো আমাদের এখানে হয়নি বলে তিনি মনে করেন। তিনি মনে করেন, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তিনি এ জন্য নগদ লেনদেনের পরিবর্তে ইলেকট্রকিস লেনদেন বিশেষ করে এটিএম কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং বাড়ানো পরমার্শ দিয়েছেন তিনি।

ডিএসই সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক হিসেবে ডিএসইএক্স ৪ হাজার ৫৫ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ডিএসইএক্স চালু হওয়ার পর এমন ভয়াবহ দরপতন আর কখনো হয়নি।

গতকাল ডিএসই সূচকগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রধান মূল্যসূচকের পাশাপাশি করুণ দশা বিরাজ করছে ডিএসইর অপর সূচকগুলোর। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচকটি কমেছে ৮৮ পয়েন্ট। ১ হাজার ৪৬০ পয়েন্ট নিয়ে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি চালু হওয়া সূচকটি এখন ১ হাজার ৩৪৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএসইর আর একটি সূচক ‘ডিএসই শরিয়াহ্’। ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি এ সূচকটি যাত্রা শুরু করে। শুরুতে এ সূচকটি ছিল ৯৪১ পয়েন্টে। গতকাল সোমবার লেনদেন শেষে সূচকটি ৬৯ পয়েন্ট কমে ৯২৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইতে ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের দাম কমেছে ৯ শতাংশের ওপরে। দফায় দফায় দাম কমিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us