ইদ্রাকপুর কেল্লার বিস্ময়কর ইতিহাস
ইদ্রাকপুর কেল্লা - নয়া দিগন্ত
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হয় ১৫২৬ সালে। এ যুদ্ধে বাবরের হাতে ইবরাহিম লোদি পরাজিত হন। সূচনা হয় উপমহাদেশে মুঘল শাসনের। শাসনকার্য পরিচালনায় মুঘল আমলে বাংলা অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় বেশ কিছু অনন্য স্থাপত্য। মুন্সীগঞ্জের ইদ্রাকপুর কেল্লা তার মধ্যে অন্যতম। মূলত ইছামতী ও মেঘনার মিলনস্থলে দুর্গটি সামরিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নদীবেষ্টিত রাজধানী ঢাকাকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবল থেকে সুরক্ষিত রাখতে মুঘল আমলে ইছামতী নদীর তীরে নির্মাণ করা হয় ইদ্রাকপুর কেল্লা বা দুর্গ। ধারণা করা হয়, দুর্গটির নির্মাণ কাল বাংলার মুগল সুবাদার মীর জুমলার শাসনকালে (১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ)। ৩৫০ বছরের বেশি পুরনো ইদ্রাকপুর কেল্লাটি মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরে অবস্থিত। সে সময়ের ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরে ইদ্রাকপুর নামক স্থানে এই দুর্গটি নির্মিত হয়।
কালের পরিক্রমায় ইছামতীর গতিপথ পাল্টে গেছে। তবে দুর্গটির এক থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে ধলেশ্বরী, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদী এখনো বহমান। দুর্গটি নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা দুর্গের চেয়ে আয়তনে কিছুটা ছোট। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ইটের তৈরি চার কোণা দুর্গটি উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত। এর দৈর্ঘ্য ৮৬.৮৭ মিটার ও প্রস্থ ৫৯.৬০ মিটার। দেয়ালের গায়ে বন্দুকের গুলি চালানোর উপযোগী চার কোণবিশিষ্ট ফোকর আছে। দুর্গটির লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, ড্রামের পাদদেশে ভূগর্ভস্থ একটি কুঠুরি এবং কুঠুরিতে অবতরণের জন্য নির্মিত সিঁড়ি। জনশ্রুতি আছে, সিঁড়িটি ছিল একটি গোপন সুড়ঙ্গপথের অংশ, যার মধ্য দিয়ে দুর্গে অবস্থানকারীরা কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরে যেতে পারতেন। আসলে সিঁড়িটি ছিল ভূগর্ভস্থ একটি গোপন কক্ষে নামার পথ। আর কক্ষটি ছিল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ রাখার গুদামঘর। সুড়ঙ্গপথে ঢাকার লালবাগ দুর্গের সাথে এই দুর্গের যোগাযোগ ছিল বলে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে।
সুউচ্চ প্রাচীরবিশিষ্ট এই দুর্গের প্রতিটি কোণায় রয়েছে একটি বৃত্তাকার বেষ্টনী। দুর্গের ভেতর থেকে শত্রুর প্রতি গোলা নিক্ষেপের জন্য প্রাচীরের মধ্যে অসংখ্য চার কোণা ফোকর রয়েছে। একমাত্র খিলানাকার দরজাটির অবস্থান উত্তর দিকে। মূল প্রাচীরের পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে ৩৩ মিটার ব্যাসের গোলাকার উঁচু একটি পর্যবেক্ষণ মঞ্চ রয়েছে। দূর থেকে শত্রুর চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য সমসাময়িক প্রায় প্রতিটি দুর্গে এই ব্যবস্থা ছিল। এই মঞ্চকে ঘিরে আর একটি অতিরিক্ত প্রাচীর মূল দেয়ালের সাথে মিলিত হয়েছে। দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য এটি নির্মিত হয়েছিল। মুঘল স্থাপত্যের একটি অনন্য কীর্তি হিসেবে ইদ্রাকপুর দুর্গটি ১৯০৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রকাশিত মুন্সীগঞ্জের ইতিহাস (২০০৩) বইয়ে দুর্গটি সম্পর্কে লেখা হয়েছে, বারভূঁইয়াদের দমনের উদ্দেশ্যে এবং ঢাকাকে জলদস্যুদের কবল থেকে রক্ষার জন্য সুবাদার মীর জুমলা ১৬৬০ সালে ইদ্রাকপুর দুর্গ নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, এ দুর্গকে ঘিরেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে মুন্সীগঞ্জের বসতি। দুর্গ থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ইদ্রাকপুর নামে একটি এলাকাও রয়েছে।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় মুঘলদের পতন হলে ইদ্রাকপুর দুর্গটি ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে মহকুমা গঠিত হওয়ার পর প্রশাসকরা ইদ্রাকপুর দুর্গকে বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। জেলা প্রশাসকরাও একই ধারা অনুসরণ করেন। দুর্গটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়লে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে দুর্গের ভেতরেই জেলা প্রশাসকদের জন্য নতুন বাংলো নির্মাণ করা হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর গত বছর দুর্গটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
সরেজমিন দেখা যায়, দুর্গের প্রাচীরে চুন-সুড়কি দিয়ে রঙ করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত পুরনো জেলখানা ভবনে জাদুঘর স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে জাদুঘরের নাম এখনো ঠিক হয়নি। মুন্সীগঞ্জ জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মতিউল ইসলাম ও সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম এ কাদেরসহ স্থানীয় অনেকের প্রস্তাব, জাদুঘরের নাম হোক ‘মুন্সীগঞ্জ প্রতœতত্ত্ব জাদুঘর’।
এ দিকে দুর্গের ভেতরে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয় ও তাদের কর্মচারীদের থাকার জন্য ছোট ছোট নির্মিত ঘর দুর্গের সার্বিক সৌন্দর্য নষ্ট করেছে। বাইরে প্রধান ফটকের পাশে পৌরসভার নির্মিত শৌচাগার ও টেনিস ক্লাবের ভবনটি দুর্গের সৌন্দর্যে আরো বড় অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে এসব স্থাপনা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ঢাকা অঞ্চল কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে দুর্গ সংস্কার ও জাদুঘর নির্মাণের জন্য ৫৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে ওই অর্থ ব্যয় করা হয়। এ কাজের অংশ হিসেবে দুর্গের ওপরের বাংলোটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে আঞ্চলিক সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। জাদুঘর স্থাপন ও সংস্কারের বাকি কাজের জন্য দ্বিতীয় ধাপে পাঁচ লাখ টাকার আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। সেই প্রকল্পটি এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায় নয়া দিগন্তকে বলেন, জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলো ও অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ, ইদ্রাকপুর দুর্গের সংস্কার-সংরক্ষণ কাজ, ইদ্রাকপুর দুর্গে পুরনো জেলখানাকে জাদুঘরে রূপান্তরের লক্ষ্যে ছাদ নির্মাণসহ জেলখানা মেরামত কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ইদ্রাকপুর দুর্গে বিদ্যুতায়ন, গণশৌচাগার, আবর্জনা অপসারণ, পুকুর পাড় বাঁধাই ও বাগান বিন্যাসের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ইদ্রাকপুর দুর্গে কোনো সংস্কার-সংরক্ষণ ও নির্মাণকাজ চলমান নেই।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। শিগগিরই উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করবেন তারা।