শ্রিংলার সফর এবং কিছু কথা

শ্রিংলা - ছবি : সংগ্রহ
সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকা সফর করে গেলেন। এই সফরকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্লেষণ এখানে প্রকাশ করা হলো
ভারতের হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে আমরা দেখছি তিনি ব্যাকফুটে ও নিষ্প্রভ। তা না হয়ে তার উপায় কী? এমনকি শ্রিংলার ঢাকায় থাকা অবস্থায় ৩ মার্চ আনন্দবাজারের এক রিপোর্টও তার সঙ্কটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ পত্রিকা লিখেছে, ‘সিএএ-এনআরসি বিতর্কের প্রভাব পড়েছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে। দিল্লির হিংসা, সেই ক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। সে দেশের মন্ত্রী-পর্যায়ের একাধিক জনের ভারত সফর বাতিল করেছিল হাসিনা সরকার। আজ সেই তালিকায় নতুন সংযোজন, বাংলাদেশের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর নয়াদিল্লি সফর।’ এই খবর মোদি ও শ্রিংলার জন্য বিরাট অস্বস্তির সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের স্পিকারের ভারত সফর ছিল ২-৫ মার্চ। তিনি সফর বাতিলের ঘোষণা দেন মাত্র একদিন আগে, ১ মার্চ; যেন শ্রিংলার বাংলাদেশ সফরে আসা নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন তিনি। শ্রিংলা ঢাকা আসেন পরের দিন ২ মার্চ। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের স্পিকারের সফর বাতিলের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি বা তা পারেননি। অর্থাৎ এটা মেনে নিয়ে হলেও ব্যাকফুটেই স্বস্তিবোধ করছেন।
শ্রিংলা ২ মার্চ সকালে বাংলাদেশে নেমেই ভারতীয় হাইকমিশনের সহ-আয়োজক হয়ে এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠক ছিলেন। কিন্তু এবারের সফরে তার দুর্ভাগ্য যে, তাকে সরাসরি অসত্য বলেই পার পেতে হবে, অন্য রাস্তা নেই। তাই তিনি আসলে এখানে ভান করলেন যে, এনআরসি ইস্যুটা যেন এখনো কেবল আসামেই সীমাবদ্ধ। তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যেন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেননি যে, তিনি এবার ‘ভারতজুড়ে এনআরসি করবেন’। অমিত এটা কোনো জনসভায় বলেননি, সংসদে এবং মন্ত্রী হিসেবেই বলেছেন। কাজেই এটা কোনো দলের নয়, ভারতের সরকারি অবস্থান। এ ছাড়া মোদি এমনকি দিল্লিতে নির্বাচনে হারের পরেও বলেছেন, আপাতত এনআরসি বন্ধ রাখা হচ্ছে। আর ভারতজুড়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএর বাস্তবায়নে মেতে উঠবেন তিনি। তাহলে শ্রিংলা কেন এখনো এনআরসিকে ‘আসামের ঘটনা’ বলছেন? ভারতের কোনো রাজনীতিবিদ বা মিডিয়াও তো তার কথা মেনে নেয়ার কথা না। এযুগে ভারতের সরকারে কে কী প্রতিদিন বলেন তা বাংলাদেশে বসে জানা কি খুবই কঠিন! এনআরসি এখন ভারতজুড়ে বাস্তবায়নের ইস্যু আর এটা এখন এনআরসি-সিএএ ইস্যু। অথচ শ্রিংলা সেমিনারে বলে গেলেন এনআরসি ‘প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায়’ চলছে। তাই তিনি দাবি করলেন, ‘ ... সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের ওপর এর কোনো প্রভাব থাকবে না। আমরা এ ব্যাপারে আপনাদের আশ্বস্ত করছি।’ জানতেন কেউ তার এ কথা এ দেশে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু তবু এই চাতুরী ছাড়া কিইবা তিনি করতে পারতেন? সম্ভবত এত অসহায় অবস্থায় হয়তো তিনি এর আগে নিজেকে দেখেননি! তিনি আরো বানিয়ে বলেছেন, সিএএ বা ‘নাগরিকত্ব বিল কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়’। বলেছেন দ্বিতীয়ত, ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে এসে যারা ভারতে আছেন, তাদেরকে দ্রুততার সাথে নাগরিকত্ব দেয়াই এর উদ্দেশ্য এবং তৃতীয়ত, এটি (বাংলাদেশের) বর্তমান সরকারের সময়ের জন্য কার্যকর হবে না। কার্যকর হবে ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসক ও অন্য সরকারগুলোর সময়ে, যারা এখানে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার দেয়নি।’ এ কথাগুলো সত্য নয়। কারণ সিএএ আইন প্রযোজ্য হবে বা কাট অফ ডেট হলো ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪। মানে এর আগে যারা ভারতে প্রবেশ করেছে। কাজেই কেবল ‘১৯৭৫-পরবর্তী’ সময়টি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এই কথাটাই ভুয়া, ভিত্তিহীন। বুঝাই যায় ঢাকা সরকারের মন পাওয়া, তাদের খুশি করার জন্য এ কথাগুলো বলা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সিএএ আইনের মধ্যে বাংলাদেশের নাম সরাসরি উল্লেখ করা আছে এবং তা অমুসলিমদের ‘নির্যাতনকারী হিসেবে’। কাজেই ভারত এখন বাংলাদেশকে অমুসলিমদের ‘নির্যাতনকারী দেশ হিসেবে’ আনুষ্ঠানিক প্রমাণ পেশের আগে এ নিয়ে শ্রিংলা বা ভারত কোনো কথা বলতে পারেন না। অথচ বাংলাদেশের নাম বিজেপি সরাসরি আইনের মধ্যে উল্লেখ করে দিয়েছে- পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণ করতে বা হিন্দু ভোট সব নিজের রাজনৈতিক ঝুলিতে পেতে।
বাংলাদেশে এই সফরে শ্রিংলা আরেক বিরাট মুলা ঝুলিয়েছেন- তিস্তার পানি তো বটেই, ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মোট ৫৪ নদীর মধ্যে আরো নাকি ছয়টি পানি দেয়ার চুক্তি করতে যাচ্ছে। এটা অবিশ্বাস্য আর তাদের বিশ্বাস করার মতো আস্থা তারা অনেক আগেই হারিয়েছেন। ওই সেমিনারে শ্রিংলা এমন সব কথা বলেছেন, যা দেখেই বুঝা যায় বানানো কথা বলছেন। আসলে মন জয়ের চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা প্রমাণিত যে, ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও ন্যায্য বণ্টন করার মধ্যেই আমাদের বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ নিহিত।’ অথচ এটা ভারতের অবস্থানই নয়, এ পর্যন্ত ভারতের অনুসৃত নীতি নয়। কার্যত তাদের অবস্থানটাই উল্টা। আমরা দেখছি ‘পরিবেশের’ কথা তিনি বলেছেন। যৌথনদীর ক্ষেত্রে পরিবেশ বিবেচনায় টেকনিক্যাল নিয়ম হলো, নদীর ‘অবাধ’ প্রবাহ বজায় রাখতে হবে। অথচ এ বিষয়ে ভারতের পরিবেশবোধ শূন্য এবং তাদের ভূমিকা পরিবেশবিরোধী। ভারত বহু আগে থেকেই হয় নদীতে সরাসরি বাঁধ দিয়েছে, না হলে আন্তঃনদী যুক্ত করার মতো চরম পরিবেশবিরোধী প্রকল্প নিয়েছে। আর তাও না হলে নদীর মূল প্রবাহ থেকে বড় খাল কেটে পানি বহু দূরে টেনে নিয়ে গেছে। এই হলো ভারতের কথিত পরিবেশবোধ।
আর টেকসই? নদীর ওপর যেসব বাড়াবাড়ি ভারতে হচ্ছে তাতে এগুলো একটাও টিকবে না, মূল নদীই শুকিয়ে যাবে ক্রমেই। ফারাক্কা ইতোমধ্যেই এ অবস্থায়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধ ভারতের বিহারে প্রতি বছর বন্যার কারণ বলে অভিযোগ উঠছে এখন।
আর ন্যায়সঙ্গত বণ্টন? মানে যৌথ নদীর ক্ষেত্রে আইন? এসব নদীর ক্ষেত্রে ভাটির দেশের প্রাপ্য, সমান হিস্যা ভারত দিতে আইনত বাধ্য। আমাদের সম্মতি ছাড়া বাঁধসহ নদীর প্রবাহকে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত করা বেআইনি। অথচ ভারতের সাথে নদীর পানি বণ্টনের যেকোনো আলোচনায় তাদের দাবি অনুযায়ী বণ্টনের ভিত্তি হলো ‘ভারতের প্রয়োজন মিটানোর পরে পানি থাকলে তা বাংলাদেশ পাবে’। এই নীতিতেই ভারত চলে। এ ছাড়া প্রায় সব সময়ের যুক্তি হলো ‘এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। তাই আরো কম পানি পাবে বাংলাদেশ’। অর্থাৎ ভাটির দেশ হিসেবে পানি আমাদের প্রাপ্য এই আন্তর্জাতিক আইনি ভিত্তি তারা মানে না। কথা হলো, ভারতের পানির প্রয়োজনের কোনো শেষ কি থাকবে?
সোজা কথা ‘পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও ন্যায্য বণ্টন’ এই শব্দগুলো শ্রিংলা তুলেছেন- কথার কথা হিসেবে এবং মন ভুলাতে। অথচ না পরিবেশ রক্ষা, না আন্তর্জাতিক নদী আইন- ভারতের চলার ভিত্তি বা সরকারের নীতি নয়। আসলে শ্রিংলা দেখালেন, পুরো বানোয়াট কথা বলার মতো নার্ভ তার আছে। আর সম্ভবত তিনি ভেবেছেন, বাংলাদেশ তবুও তাকে বিশ্বাস করবে বা আস্থা রাখবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com