যা বললেন জাফরুল ইসলাম খান
জাফরুল ইসলাম খান - ছবি : সংগ্রহ
বাংলাদেশে এসে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা দিল্লি ম্যাসাকার নিয়ে একটা কথাও বলেননি। অজুহাত সম্ভবত, এটা অভ্যন্তরীণ ইস্যু। কিন্তু বাস্তবতা হলো- লাগাতার তিন দিন ধরে এ হত্যাযজ্ঞ বা ম্যাসাকার চলেছে; দিল্লি জ্বলেছে, কমপক্ষে ৫৮ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। মুসলমানদের বাড়িঘর যতটুকু সম্পদ সব কিছু পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রথম কারা সুনির্দিষ্টভাবে দিল্লি ম্যাসাকার করেছে তার কিছু তথ্য সামনে আসা শুরু হয়েছে।
দিল্লি ভারতের বিশেষ মর্যাদার টেরিটরি, তা সত্ত্বেও দিল্লি একটা রাজ্য। তাই রাজ্যের ‘বিধানসভা’ নামের সংসদ (প্রাদেশিক পার্লামেন্ট) আছে। সেখানে রাজ্য প্রয়োজনীয় আইনও প্রণয়ন করতে পারে, যা কেবল নিজ রাজ্যের ওপর প্রযোজ্য। দিল্লির বিধানসভায় ১৯৯৯ সালে এমনই একটা আইন পাস করা হয়েছিল, যার নাম ‘দিল্লি মাইনরিটি কমিশন অ্যাক্ট ১৯৯৯’। এ দিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ অর্থে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন নয়। আইনের মারপ্যাঁচ ও দুর্বলতায় এটা নির্বাহী ক্ষমতার মুখাপেক্ষী হয়েই চলে। সে তুলনায় ভারতের অধিকারবিষয়ক কমিশনগুলো এত ঠুঁটো নয়। বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ভারতের আদালতের পর্যায়ে স্বাধীন। যেমন ভারতের ‘জাতীয় নারী কমিশন’ যথেষ্ট প্রভাবশালী ও কর্তৃত্ব রাখে। তেমনি ‘দিল্লি মাইনরিটি কমিশন অ্যাক্ট’-এর অধীনে রাজ্য সরকার এক ‘দিল্লি মাইনরিটি কমিশন’ (ডিএমসি) গঠন করে দিয়েছে। এর মূল কাজ হলো, ‘সংখ্যালঘু বা মাইনরিটিদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষা’। এরা পুরোটা আদালতের পর্যায়ের না হলেও তারা অনেক ক্ষমতা রাখেন। যেমন ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নর্থ দিল্লিতে কার্ফু জারি করতে তারাই পুলিশকে চিঠি দিয়েছিলেন।
সেই ডিএমসি সরেজমিন দিল্লির ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সফর শেষে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। অচিরেই একটা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গড়ে তারা মাঠে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন, যে কমিটিতে আইনজ্ঞ, সাংবাদিক ও সিভিল সোসাইটির সদস্যরা যুক্ত থাকবেন। এই কমিশন বা ডিএমসির চেয়ারম্যান হলেন জাফরুল ইসলাম খান ও অন্য সদস্য হলেন কারতার সিং কোচার। এরা প্রথম সরেজমিন রিপোর্ট মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রথম কথা হলো, এই হামলা ‘একপক্ষীয়’ এবং ‘পূর্বপরিকল্পিত’। অর্থাৎ এটা কোনো দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে মারামারি বা রায়ট নয়। অথবা এটা হঠাৎ উত্তেজনায় ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। বরং আগেই পরিকল্পনা করে ঘটানো সন্ত্রাস। বিভিন্ন মিডিয়ার সাথে তাদের কথা বলার সময় জাফরুল ইসলাম খান সাহেবের করা কিছু মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
তার ফাইন্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় মন্তব্য হলো, প্রায় দুই হাজার বহিরাগতকে পরিকল্পিতভাবে নর্থ-ইস্ট দিল্লিতে এনে, কয়েকটা স্কুলে রেখে তাদের দিয়ে এই ম্যাসাকার, হত্যা ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে এক প্রত্যক্ষ সাক্ষীর বয়ান তারা সংগ্রহ করেছেন। তার নাম রাজকুমার। তিনি রাজধানী স্কুলের গাড়ির ড্রাইভার। তিনি বলেছেন, এরকম ৫০০ বহিরাগত যাদের মুখে মুখোশ ছিল। এরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা ওই স্কুলে অবস্থান করেছিল। তারা সাথে
পিস্তল নিয়ে সশস্ত্র ছিল আর এক ধরনের ‘বড় গুলতি’ ব্যবহার করেছিল উঁচু দালান থেকে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারার জন্য। কমিশনও বলেছে, তারা এমন কিছু ব্যক্তির ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন।
এ ছাড়া জাফরুল ইসলামের দাবি, তারা জেনেছেন প্রত্যেক গলি থেকেই স্থানীয় অন্তত দু-একজন সহযোগী ছিল যারা মুসলমানদের বাড়ি , দোকান, গুদাম বা সম্পদ কোনগুলো, তা দেখিয়ে দিয়েছে। যাতে কেবল সেগুলোতেই আগুন লাগিয়ে দেয়া যায়। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এভাবেই ‘যমুনা বিহার’ এলাকা ছাড়া সব জায়গাতেই কেবল বেছে বেছে মুসলমানদের বাড়িঘর ও সম্পদ পোড়ানো হয়েছে।
এই প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করা নিয়ে লুকোচুরি শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ ‘মেনস্ট্রিম মিডিয়া’ এটা ছাপেইনি। সবচেয়ে বিস্তারিত ছেপেছে দক্ষিণের ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য হিন্দু’। এ ছাড়া ওয়েব পত্রিকা ওয়াইর আর নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এটা ছেপেছে। আরো কিছু পত্রিকা ছেপেছে,তারা কেবল সরকারি সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের শর্ট ভার্সনটা ছেপেছে। তবে একটা ইউটিউব ভার্সন পাওয়া যায় এক সংশ্লিষ্ট মিডিয়া ‘এইচডব্লিউ নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে। সেখানে এ নিয়ে নিউজ ছাড়াও চেয়ারম্যান জাফরুল ইসলাম খানের সাক্ষাৎকারও প্রচারিত করেছে।
দেখা যাচ্ছে, ফ্যাক্টস বাইরে আসা শুরু হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধেও মোদি-অমিত কোনো কৌশল গ্রহণ করবেন সন্দেহ নেই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com