সংসদে কী হচ্ছে!
সংসদে কী হচ্ছে! - ছবি : সংগ্রহ
বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে। ফলে সংসদই জাতির সব সমস্যার আলোচনা ও সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু। বিগত দু’টি টার্ম থেকে সংসদ কিভাবে গঠিত হচ্ছে সেদিকে তাকাতে যাওয়াও যেন পাপ। যেভাবেই হোক সংসদ সদস্যরা ‘নির্বাচিত’ হচ্ছেন, সরকার গঠিত হচ্ছে এবং নিয়মিত সংসদ অধিবেশন বসছে। সংসদে অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছে; জাতি বিভিন্ন আশ্বাস পাচ্ছে। এ আশ্বাস থেকে জাতি কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তা হিসাব করা কঠিন। কারণ, এ দুই টার্মের আগের সংসদগুলো নিয়েও জনগণ সন্তুষ্ট ছিলেন না। সেখানে সংসদ বর্জন, কোরাম সঙ্কট, ওয়াকআউট, ফাইল ছোড়াছুড়ি লেগেই থাকত। দেশ ও জাতির সমস্যা এবং উন্নয়ন, আইন প্রণয়ন এসব বিষয়ে কার্যকর আলোচনা, কম দেখা যেত। এখন সংসদে জীবিত-মৃতকে গালিগালাজ, কুৎসা রটনা, বিষোদগার একচেটিয়া চলছে। আছে কেবল বক্তব্যকে ভদ্রলোকের মতো টেবিল চাপড়িয়ে অভিনন্দন জানানো এবং কোনো বিলে গভীর আলোচনা ব্যতিরেকেই হ্যাঁ জয়যুক্ত করার মহড়া। কেননা, এখানে রয়েছে সহযোগিতা করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অনুগত ‘বিরোধী দল’ সদা দণ্ডায়মান।
এই একাদশ সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশনে বিগত ১৪ ফেব্রুয়ারি চমকপ্রদ একটা ব্যাপার ঘটেছে। ঘটনাটি হলো- দেশে যে ভয়ঙ্কর ধর্ষণরোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, তার সুরাহা প্রায় ‘হয়ে যায় যায়’ পর্যায়। প্রসঙ্গটি সংসদে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোটিশ কিংবা এ ব্যাপারে আইনের কোনো সংশোধনী বিল আকারে আসেনি। এসেছে নেহায়েত পয়েন্ট অব অর্ডারের সুযোগে। জঘন্য এ অপরাধের লাগাম টানতে, সম্ভব হলে চিরতরে বন্ধ করার কলাকৌশল সম্পর্কে বিজ্ঞ কয়েকজন সদস্য তাদের মতামত বা সুপারিশ স্পিকারের মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপন করছেন। তাদের বক্তব্য এরকম যে- এসব জঘন্য অপরাধীকে কোনো মতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এ অপরাধের যথাযথ বিচার হয় না, হলেও বা দীর্ঘ সময়ের সুযোগে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে অপরাধে ওরা জড়িয়ে পড়ে।
সুতরাং সমাজকে পরিশুদ্ধ এবং নারীসমাজকে নিরাপদ করতে এ অপরাধীদেরকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। মেরে ফেলতে হবে। তবে এ মারা লগি-বৈঠা বা গণপিটুনি দিয়ে নয়; গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নিয়ে সরাসরি বন্দুকের নলে। সোজা কথায় ‘ক্রসফায়ারে’ দিয়ে শেষ করে দিতে হবে তাদের। অবশ্য এমপিরা কথা বলেছেন গুছিয়ে, উত্তেজিত না হয়ে। সব চেয়ে চমৎকারভাবে অনেকটা সমাপনী বক্তব্যের মতো কথা বলেছেন একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ডাকসুর খ্যাতিমান ভিপি সরকারি দলের প্রবীণ ও বর্তমানে কিছুটা শ্রান্ত একজন নেতা। তিনি বলেছেন, মাদকের ব্যাপারে যদি সাথে সাথে শেষ করে দেয়া যায়, ধর্ষণে কেন যাবে না? তিনি আরো বলেছেন, আমি যদি চিনি, সেই এ কাজ করেছে; তার আর এ পৃথিবীতে থাকার অধিকার নেই।
এ ক্রসফায়ার এবং বন্ধুকযুদ্ধের কথা শুনলে গা শিউরে উঠে। দেশে একসময় সন্ত্রাসী এবং দাগী মাস্তানদের উৎপাত খুব বেশি বেড়ে যায়। এদের দমনের জন্য বিশেষ বাহিনী ‘র্যাব’ গঠন করে তাদের এ গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়। তারা তাদের কাজ কিছুদিন চালিয়ে যায় এবং অনেক সন্ত্রাসী মারা যায়, হাত-পা হারায়। অনেক নির্দোষ লোকও যাতনা ভোগ করেছেন। বিনাবিচারে এসব হত্যার জন্য এ বিশেষ বাহিনীকে ইনডেমনিটি দেয়া হয়, যা খুবই সমালোচনার মুখে পড়েছিল। সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে ভুক্তভোগীরা খুশি এবং উপকৃত হলেও সাধারণ জনগণ এটাকে ভালোভাবে নেয়নি।
ফলে ২০০২ সালে ‘ক্লিন হার্ট অপারেশন’ আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনা হয়। সেকাল গত হওয়ার অনেকদিন পর সে কর্মই নব উদ্যমে এবং নতুন আঙ্গিকে জোরেশোরে আবার চেপে বসেছে গত কয়েক বছর ধরে। তবে এ কাজের কোনো ঘোষণা নেই, কোনো নামও নেই; দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার খাতিরে রুটিন কাজ হিসেবে তা করা হচ্ছে। এ নীরব নিয়মিত কাজের মধ্য দিয়ে কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়েছে, কত নিপীড়তের পরিবার বিনষ্ট হয়েছে তার হিসাব রাখা হয় না। এসবের বিচার তো দূরের কথা, মামলাও করা যায় না, আত্মীয়ের খোঁজের জন্যও যাওয়া যায় না, বরং নিজেরই গুম হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকতে হয়। ‘দুষ্ট কীট’ দমনে যারা হারিয়ে গেছে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীই বেশি। তারা সত্যিই সন্ত্রাসী ছিল কি না দেশের মানুষ তা ভালোভাবে জানে না। এ কর্মের শিকারদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও রয়েছেন নামী-দামি ভালো চেনা-জানা মুখ অনেক।
তাদের কেউ কেউ ক্রসফায়ারে না পড়লেও গুমের শিকার হয়ে কিছুদিন পর ‘বোবা’ হয়ে অজ্ঞাত স্থান থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ফিরে এসেছেন; আবার কারো বা কোনো হদিস নেই। হদিস দেয়ার গরজও কারো নেই। এ ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ এবং এনকাউন্টারকে সংসদ সদস্যরা আবার বৈধ করতে চাচ্ছেন। যে অপারেশনের নিন্দা পঞ্চমুখে করেছেন, সে অপারেশনকে আবার কার্যকর এবং অত্যাবশ্যকীয় বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টার পরিচালনা করার বিধান দেশে রয়েছে বলে জানা নেই। আমাদের জানা মতে, এসবই বেআইনি এবং চরম নিপীড়ন। তবে হ্যাঁ, আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি করার অধিকার রয়েছে। তবে তাদের সব গুলিতেই যে প্রতিপক্ষ মারা যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্ত আমরা তো তা-ই দেখছি। তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যায়- সন্ত্রাসী, মাদকের কারবারি, পাচারকারী ও সেবনকারী, জঙ্গি বা উগ্রবাদী, চাঁদাবাজ এবং ক্যাসিনোবাজ- এরা সংঘবদ্ধ থাকে। তাদের অবৈধ অস্ত্রভাণ্ডার থাকে। তাদের কাউকে পাকড়াও করা সম্ভব হলে সহযোগিদেরও ধরা, শাস্তি প্রদান করা এবং অস্ত্র উদ্ধার করা দেশের জন্য জরুরি। কিন্তু ধর্ষকরা সংঘবদ্ধভাবে এবং তাদের অস্ত্রভাণ্ডার থাকে বলে কি অনুমান করা হয়? তাদের অস্ত্র না থাকলে তাদের সাথে ক্রসফায়ারিং বা বন্দুকযুদ্ধ হবে কিভাবে? যেসব ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের বিবরণ শোনা যায়, তাতে দেখা যায় সন্ত্রাসীকে নিয়ে তাদের অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়াকালে ওঁৎপেতে থাকা তার সহযোগীরা তাকে ছাড়িয়ে নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি গুলি ছুড়ে। তখন ধৃত সন্ত্রাসী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধ্য হয়ে ছোড়া গুলিতে রাতে রাস্তার পাশে কোনো খাল-বিলের কিনারে একাই মারা পড়ে। সাধারণত তার সহযোগী কেউ তো না-ই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউই আহতও হন না। অতি নিখুঁত প্রশিক্ষিত নিশানা। এ কার্যক্রমের দেখভালের কোনো ব্যবস্থা নেই, নালিশ-বিচার নেই। একবারেই যেন আপদ বিদায়।
কম সময়ে অধিক ফলদায়ক ফায়সালা হয়তো চলতে থাকবে। কিন্তু সংসদসদস্যরা ধর্ষকদের ক্রসফায়ারিংটা করাবেন কিভাবে- সেটা বড় প্রশ্ন। তাদের প্রধানত থাকে অমার্জনীয় যৌন নেশা এবং মতিবিভ্রাট। যা করতে হবে তা হলো অস্ত্র থাকুক বা না থাকুক, ধরে নিয়েই ফুটুস? এখানে পুলিশই পাকড়াওকারী-তদন্তকারী, তারাই আইন ও বিচারক এবং রায় বাস্তবায়নকারী। সংসদ সদস্যরা বলেছেন- টাঙ্গাইলে বাসে ধর্ষণের পর পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর সেদিন যদি মধুপুরে নিয়ে গুলি করে মারা হতো, তাহলে নাকি আর ধর্ষণ হতো না।’ কিন্তু অগ্রসর সমাজে কি এমন ওয়ানস্টপ সার্ভিস রয়েছে?
যদি এমন কোনো ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে তা হবে নরহত্যা। কোনো অভিযুক্তকে যত বড় অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হোক; বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে বেত্রাঘাত করাও মেনে নিতে পারি না। কোনো আইনই তা হজম করবে না। ধর্ষক নামক জঘন্য অপরাধী ও পাপাচারীকে কে না ঘৃণা করে, কে না শাস্তি চায় ওদের? তাই বলে দায়ীর বিচার না করেই শেষ করে দিলে আরেক পাপের উদ্ভব ঘটতে পারে। মূলত দেশে আকাশ কুসংস্কৃতির সম্প্রসারণ, ক্যাসিনো-জুয়ার আসর বজায় এবং মাদক সহজলভ্য রেখে এ রোগ সহজে দমন করা যাবে না।
নিকৃষ্ট এ পাপাচারের ব্যাপারে যথাযথ বিচারের মাধ্যমে শাস্তির বিধান পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে এবং এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সর্বনাশা এ অপরাধ থেকে সমাজকে নিরাময়ের কথা বলা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা হয়তো সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করেন না। এছাড়া মৌলবাদী, মধ্যযুগীয় এবং অমানবিক ইত্যাদি তকমা পাওয়ার ভয়ও হয়তো রয়েছে।