প্রিন্স মোহাম্মদ ফয়সালের অনন্য ব্যক্তিত্ব

প্রিন্স মোহাম্মদ ফয়সাল - সংগৃহীত
আমি তখন পাপুয়া নিউগিনিতে অধ্যাপনা করছি। ১৯৭৬ সালের কথা। আগের বছর ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) যাত্রা শুরু করেছে। আমি আইডিবিতে ইন্টারভিউ দিয়ে পাপুয়া নিউগিনিতে ফিরে এসেছি। আসার পর আইডিবির পাশাপাশি কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও চাকরির অফার পাই। এ দুয়ের মধ্যে আমি শিক্ষকতার চাকরিকেই বেছে নিই। আমি যখন সৌদি আরব যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন অনেকেই বলেছিলেন, এটা খুবই কঠোর অনুশাসনের একটি দেশ, সেখানে এক বছরের বেশি থাকতে পারব না। মানুষ খুবই রুক্ষ চরিত্রের। সৌদি পুলিশের আচরণ অমার্জিত। এসব নেতিবাচক কথা শুনে মনটা কিছু দমে গেলেও ভাবলাম এক বছরের জন্যই তো যাচ্ছি (সাবাটিক্যাল লিভ নিয়ে)। তা ছাড়া কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তির মেয়াদও ছিল এক বছরের (নবায়নযোগ্য)। মন না টিকলে চলে আসব। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর এর প্রেসিডেন্ট ড. আহমেদ জুবেরি জানালেন, আমাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ অন ইসলামিক ইকোনমিকস’-এ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বললাম, আমার কী কাজ। আমি তো আরবিতে লেকচার দিতে পারব না। তিনি বলেন, তোমার আরবি পড়ানোর দরকার নেই, ইংরেজিতে লেকচার দিলেই চলবে। আমরা ‘ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অন ইসলামিক ইকোনমিকস’ সেটআপ করছি। তুমি সেখানে কাজ করবে। আমি জিজ্ঞাসা করি, সেন্টারটি কোথায়। তিনি বললেন, বাদশাহর কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আমি কিছুটা হতাশই হলাম। ভাবলাম কী ব্যাপার, আমাকে এখানে আসতে বলল। অথচ কিছুই নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায় বসব। বলা হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ওমর নাসিফের পরিবারের একটি পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে, আপাতত সেখানেই সেন্টারের কাজ শুরু হবে। তবে শিগগিরই নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে।
যা হোক, সেন্টারে জয়েন করলাম। কিন্তু গিয়ে আরি বিপদে পড়ি। আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েক দিন পর সেখানে একজন পরিচালক নিযুক্ত হলো। এ ধরনের প্রশাসনিক পদে সাধারণত সৌদিদেরই নিয়োগ দেয়া হয়। তার নাম ছিল ড. হাসান আল বালকি। তিনি ছিলেন ইকোনমিক ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। পরে তিনি জেদ্দার ডেপুটি মেয়র হয়েছিলেন। বালকি প্রতিদিন ঘণ্টা খানেকের জন্য এসে বসতেন। আমাদের বয়স প্রায় কাছাকাছি ছিল, তিনিও আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছেন, আমিও আমেরিকা থেকে ডক্টরেট করেছি। ফলে আমাদের মধ্যে মনের বা ধারণাগত মিল ছিল। আমরা দু’জনে বসে ধারণাগুলো শেয়ার করতাম। একদিন বালকিকে বললাম, আমাদের একজন পিয়ন দরকার। পিয়ন পাওয়া গেল। কিন্তু তাকে নিয়ে আরেক বিপদ। এ ধরনের পদেও সৌদিরা নিয়োগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট তাদের নিয়োগ দেন। সে প্রতিদিন ১০টা বা ১১টার দিকে আসত। এসে আমাদের সাথে কোলাকুলি করে, মারহাবা... মারহাবা করতে চলে যেত। ঘণ্টাখানেকও থাকে না। ভেবেছিলাম পিয়ন পেলে তাকে দিয়ে চা, নাশতা আনিয়ে খাওয়া যাবে। কিন্তু সেটি তো দূরের কথা ঘরের মধ্যে ধুলা জমে আছে কি না সে দিকেও সে তাকায় না। তখন ভাবলাম এ তো সাংঘাতিক দেশ। আমি বালকিকে ‘ব্রাদার’ বলতাম। তাকে বললাম, ব্রাদার বিষয়টি কী দাঁড়াল। তিনি বললেন, এমনই। এদের অনেক ক্ষমতা। কিছু হলেই প্রেসিডেন্টের কাছে সরাসরি অভিযোগ করবে। কিছু হলে প্রেসিডেন্ট তোমাকে আমাকে বাদ দিয়ে এর কথা প্রথম শুনবে।
আমি কিছুটা দমে গেলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম যে এটা আসলে সৌদি আরবের সামাজিক রীতি বা প্রথা। আমরা মনে করি তারা বুঝি খুবই নির্দয়। কিন্তু রাস্তার একজন লোকও যদি বাদশাহর কাছে গিয়ে তার সমস্যার কথা বলে বাদশাহ তার সমস্যার সমাধান করে দেবেন। আমাদের সেন্টারের জন্য একটি ফটোকপি মেশিন কেনা হয়েছে। কম্পিউটার তখনো আসেনি। ফলে ঘরের মধ্যে কাগজপত্রের স্তূপ জমতে থাকে। এ দিক-সে দিক কাগজ পড়ে থাকে। পিয়নকে দিয়ে কিছু হচ্ছে না দেখে একদিন ভাবলাম হাত-পা যখন আছে তখন নিজেই পরিষ্কার করে ফেলি। সাফসুতরা করতে শুরু করলাম। একদিন ঝাড় দেয়ার সময় হঠাৎ ড. বালকি চলে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, কী করছ। বললাম, পরিষ্কার করছি। আমার দেখাদেখি তিনিও পরিষ্কার করতে লেগে গেলেন। এরপর একজন সিরিয়ান আরব, ড. নাজ্জারকে নিয়োগ দেয়া হলো, তিনি পেনসিলভেনিয়া থেকে ডক্টরেট করেছেন। তার সাথেও আমার ভালো সখ্য হয়ে গেল। তখন পর্যন্ত আমরা দু’জনই রিসার্চ সেন্টারের জনবল। এবার কাজ ভাগাভাগি করার পালা। তখন পোস্ট অফিসে গিয়ে চিঠিপত্র নিয়ে আসতে হতো। এগুলো পিয়নের কাজ হলেও তাকে পাওয়া যেত না। ফলে কাজটি আমরা ভাগাভাগি করে নিলাম। এক সপ্তাহ সে, আর আরেক সপ্তাহ আমি গিয়ে ডাক নিয়ে আসতাম।
আসলে মনেপ্রাণে চাচ্ছিলাম সেন্টারটাকে গড়ে তুলতে। এ কাজে আমার কোনো অহমিকা ছিল না। ধীরে ধীরে সেন্টারে ছাত্র আসা শুরু হলো। সেখানে দু’টি ওয়াশরুম ছিল। একটি ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য। আরেকটির চাবি নিজের কাছে রাখতাম। সেখানে অনেক জ্ঞানীগুণী লোক আসতেন। যেহেতু আমার বইয়ের সুবাদে আমি কিছুটা পরিচিত ছিলাম; তাই কেউ ইউনিভার্সিটিতে এলেই আমার সাথেও দেখা করতে আসতেন। তাদের প্রয়োজনে আমি নিজেই ওয়াশরুম খুলে দিতাম। এটা নিয়েও প্রেসিডেন্টের কাছে অভিযোগ গেল। একদিন তিনি আমাকে বললেন, ড. মান্নান তুমি নাকি ওয়াশরুম বন্ধ করে রেখেছ। আমি তখন বিষয়টি তাকে ব্যাখ্যা করে বললাম।
আমাকে সৌদি আরবে নেয়ার পেছনে যে লোকটি কাজ করেছিলেন তিনি ছিলেন মিসরের আহমেদ আল নাজ্জার। আহমেদ নাজ্জার বিশ্বে প্রথম ইসলামী ব্যাংক ‘মিট ঘামার’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন।
১৯৭৬ সালের আগে তার সাথে আমার চাক্ষুষ দেখা না হলেও লেখালেখির কারণে ষাটের দশক থেকেই আমাদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয় ছিল। তিনি কিং আবদুল আযিয বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তার সাথে বাদশাহ ফয়সালের ছেলে প্রিন্স মোহাম্মদ ফয়সালের (প্রিন্স মোহাম্মদ ফয়সাল আল সউদ) দারুণ সখ্য ছিল। আল নাজ্জার আইডিবির কার্যক্রম নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন না। এর একটি বিকল্প করা যায় কি না ভাবছিলেন। ফলে তিনি প্রিন্স ফয়সালকে ইসলামিক অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এর জের ধরে ১৯৮১ সালের দিকে ‘দার আল-মাল আল ইসলামিক ট্রাস্ট’ গঠিত হয়। এটি ছিল বাহামাভিত্তিক একটি বিনিয়োগ কোম্পানি এবং এর মাধ্যমে সুদমুক্ত তথা ইসলামী অর্থনীতির বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন প্রিন্স ফয়সার। এটি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে একটি ট্রাস্ট হিসেবে কার্যক্রম চালায়। ইউরোপে সুদবিহীন কোনো কোম্পানির অনুমতি নেই। কিন্তু প্রিন্স ফয়সাল অত্যন্ত প্রভাবশালী সৌদি রাজপরিবারের সন্তান হওয়ায় তাকে এই অনুমতি দেয়া হয়। প্রিন্স ফয়সালের এই প্রচেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। শুনতাম যে সৌদি রাজপুত্ররা আয়েশি জীবনযাপন করে, অপচয় করে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এ কথা যে সত্য নয়, প্রিন্স ফয়সালের কার্যক্রম ও জীবনধারা দেখে তা বুঝতে পারি। তিনি ছিলেন একজন ইসলামিক স্কলার এবং ইসলামী অর্থনীতির ব্যাপারে অন্তপ্রাণ। আল নাজ্জার আমাকে ওই ট্রাস্টে যোগ দিতে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। তিনিই আমার কথা প্রিন্সকে বলেন। একদিন প্রিন্স আমাকে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমি একটু দ্বিধায় পড়ি। রাজপ্রাসাদে কখনো যাইনি। কীরকম পোশাক পরতে হয় জানি না। আমি আহমেদ নাজ্জারকে সে কথা বললাম। তিনি অভয় দিলেন, এমন কিছু না। তিনি খুবই সাদাসিধা ব্যক্তি। আমি যে ধরনের পোশাক পরতে অভ্যস্ত সেটি পরেই যেতে পারব। শেষ পর্যন্ত স্যুটই গায়ে দিলাম, রাজপুত্রের সাথে দেখা করতে যাবো বলে কথা।
প্রিন্সের বাড়িতে যাওয়ার পর পরিচয়পর্বেই তিনি বললেন, তোমাকে তো আমি চিনি। তুমি ‘ইসলামিক ইকোনমিকস : থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ বইটি লিখেছ না? সেটি রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবিতে অনুবাদ হয়েছে। তুমি কবে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছ? তখন বিনয়ের সাথে বললাম, ‘আমি ভেবে দেখব, চেষ্টা করব জয়েন করার জন্য।’ তখনো আমি কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইডিবিতে জয়েন করিনি। তবে আগে থেকেই আমার একটি মনোভাব ছিল যে, কখনো প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনো ব্যক্তির অধীনে কাজ করব না। আলোচনার একপর্যায়ে খানাপিনার আয়োজন করা হলো। দেখি বিশাল থালায় আস্ত দুম্বা হাজির করা হয়েছে। দুম্বার মধ্যে চাল ও অন্যান্য মসলাপাতি দিয়ে যে এভাবে রান্না করা যায় সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। খুবই সুস্বাদু এই খাবার। দুম্বা জবাই করার পর ভেতরের নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করে সেখানে চাল ও অন্যান্য মসলাপাতি ভরে নিয়ে কয়লা দিয়ে পোড়ানো হয়। দুম্বার মধ্যেই চাল সেদ্ধ হয়। থালার মধ্যে আস্ত দুম্বা দেখে আমি হা হয়ে গেলাম। দেখি খাওয়ার জন্য প্রিন্সসহ সবাই মাটিতে বসে গেছেন। আমি প্যান্ট পরে মাটিতে কিভাবে বসব সেটি ভেবে ইতস্তত করছিলাম। তার পরও কোনো মতে বসে সবার দেখাদেখি দুম্বার গোশত ছিঁড়তে চেষ্টার করি। আমার অবস্থা দেখে প্রিন্স বললেন, ড. মান্নান তোমরা তো টেবিল-চেয়ারে খাও কিন্তু আমরা এভাবে খাই। আমি বাধা দিয়ে বললাম, না না, আমরাও মাটিতে পাটি বিছিয়ে সবাই মিলে একসাথে খাই। আমাদেরও সিস্টেম এটাই। যা হোক আমার অবস্থার কারণে আমাকে একটি প্লেট এনে দেয়া হলো, আমি তাতে কিছু গোশত-পোলাও নিয়ে খেলাম।
তখন ভাবলাম কত বড় মাপের মানুষ, অথচ কত অমায়িক। অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক, অথচ নিজ সমাজের ঐতিহ্য মেনে চলতে ন্যূনতম কুণ্ঠা নেই। তারা এভাবে অতিথি সেবা করে সেটি আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি সামান্য একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। আর সেই দেশেরই রাজপুত্র তিনি। আমাকে পাশে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন। অথচ আমাদের সামাজে সামান্য কিছু অর্থকড়ি হলেই যেভাবে কেউ কেউ নিজেকে আলাদা জগতের বাসিন্দা বলে ভাবে, সেই চিন্তাটা এসে মনে ধাক্কা দিলো।
প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই প্রিন্সের সাথে আমার সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকে। তিনি প্রায়ই আমাকে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতেন। একসময় অবস্থা এমন হলো যে, আমি ও আহমেদ নাজ্জার যেন তার ‘পকেট বুক’ হয়ে গেছি। প্রিন্স যেখানে যেতেন আমাদের নিয়ে যেতেন।
এ সময় আমার ‘দ্য মেকিং অব ইসলামিক ইকোনমিক সোসাইটি : ইসলামিক ডাইমেনশন্স ইন ইকোনমিক অ্যানালাইসিস’ বইটির পাণ্ডলিপি তৈরির কাজ শেষ হয়। বইটি প্রকাশের জন্য একজন প্রকাশক খুঁজছিলাম। ইংল্যান্ড থেকে ‘ম্যাকমিলান’ আমাকে বলল যে, তারা বইটি প্রকাশ করতে পারে; কিন্তু এর জন্য কিছু বই আমাকে কিনতে হবে। অর্থাৎ বইটি প্রকাশের জন্য তাদের কিছু টাকা দিতে হবে। ব্রিটিশরা পয়সা ছাড়া কোনো কাজ করে না। তা ছাড়া বইটি লাভজনক হবে কি হবে না তারও নিশ্চিয়তা নেই। নাজ্জার পাণ্ডুলিপিটির কথা জানতে পারলেন। তিনি এসে বললেন, দেখি তো মান্নান তোমার ড্রাফটটি দেখি। তিনি পড়ে বললেন, ভালোই তো লিখেছ। আমি এটা প্রকাশ করব। আমি প্রিন্সকে বলব এটা প্রকাশ করার জন্য। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। প্রিন্স নিজে বইটির ফরোয়ার্ড লিখেছেন, যা আমার জন্য ছিল একটি বিশাল সার্টিফিকেট। ১৯৮৪ সালে বইটি কায়রো থেকে প্রকাশিত হয়। প্রিন্স পুরো অর্থায়ন করেন। বইটি লেখার জন্য আমাকেও বড় অঙ্কের সম্মানী দেন। এ রকম বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই আমি ‘হাউজ অব মান্নান দাতব্য ট্রাস্ট’টি করেছি। খুব কম মানুষেরই এ ধরনের সৌভাগ্য হয়। প্রিন্স তার ট্রাস্টের অধীনে ২৬-২৭টি ইসলামিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। সেগুলোর অফিসারদের ট্রেনিং দিতে তুর্কি সাইপ্রাসে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক ব্যাংকিং’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে বইটি পাঠ্য করা হয়। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় আমার বইটি পাঠ্য করেছিল।
তবে শেষ পর্যন্ত আমার আর প্রিন্সের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়া হয়নি। আমি বিনয়ের সাথে আমার অপারগতা প্রকাশ করি। মূলত অনেক দেশ ঘুরে সৌদি আরবে গিয়ে স্থির হয়েছি। তখন পারিবারিক টানও কিছুটা ছিল। ফলে নতুন চাকরি নিয়ে সাইপ্রাস বা অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনি।
এরপর কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইডিবিতে যোগ দিই। এর পেছনে আসল উদ্দেশ্যটি ছিল থিওরির জগৎ থেকে প্রয়োগের জগতে প্রবেশ করে বাস্তব অবস্থাটি বোঝা। সেখানে আমার উপলব্ধি হয় যে ইসলামিক ইকোনমি নিয়ে কাজ করার জন্য নিজের একটি স্বাধীন ইনস্টিটিউটশন থাকা প্রয়োজন। তা ছাড়া তখন বাংলাদেশে ব্র্যাক, আশা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সুদের অত্যাচারের কথা কানে আসত। তাদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখি সেগুলো শোষণের হাতিয়ার মাত্র। এদের তো আর প্রতিরোধ করতে পারব না, কিন্তু অন্তত প্রতিবাদটা করি, যত ক্ষুদ্র আকারেই হোক না কেন। ফলে আইডিবি থেকে প্রিমেচিউর রিটায়ারমেন্ট নিয়ে দেশে চলে আসি। কিন্তু প্রিন্স আমাকে ভোলেননি। তিনি আমার কর্মকাণ্ড ফলো করছিলেন। আমি সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এসআইবিএল) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে প্রিন্স ফয়সাল বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে তিনি আমাদের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবেন। তবে তার আর প্রয়োজন হয়নি। ১৯৯৯ সালে প্রিন্স ফয়সাল বাংলাদেশ সফরে এসে খোঁজ নিলেন আমি কোথায়। আমি তখন এসআইবিএলের সিটিং চেয়ারম্যান। আমি প্রিন্স ফয়সালকে ব্যাংকের বোর্ডরুমে আমন্ত্রণ জানাই। সেখানে আলাপচারিতার মাঝে হাসতে হাসতে বলেছিলাম যে, ‘দেখো, আমি এই বোর্ডের চেয়ারম্যান আর তুমি মেম্বার।’ তিনিও পাল্টা উত্তর দেন, ‘বাই অল মিনস ইউ আর মাই চেয়ারম্যান’ (সব দিক দিয়েই তুমি আমার চেয়ারম্যান)। তখন আমার এক পাশে প্রিন্স ফয়সাল, আরেক পাশে শেখ আহমেদ জামজুম বসেছিলেন। দু’জনই বিলিয়নিয়ার। জামজুম ছিলেন সৌদি আরবের বাণিজ্যমন্ত্রী। জামজুম পরিবার সৌদি আরবের বড় ব্যবসায়ী পরিবারগুলোর একটি। তিনি এই ব্যাংকে বিনিয়োগও করেছিলেন।
প্রিন্স ফয়সাল দু’বার ব্যক্তিগত সফরে বাংলাদেশ এসেছিলেন। আমি যে ব্যাংকটি করতে পেরেছি তাতেই তার উৎসাহ ছিল অনেক বেশি। এত বড় মাপের মানুষ, অথচ কত বিনয়। বড় যখন ছোট কারো কাছে যায় সেটি হয় বদান্যতা। আর ছোট যখন বড় কারো কাছে যায় সেটা হয় ভিক্ষা। ব্যাংকটি করার পেছনে প্রিন্স ফয়সালের অনেক অনুপ্রেরণা ছিল। মানুষ কতটা বিনয়ী হতে পারে সেটি তার মধ্যে দেখেছি।
তবে এরপর কয়েকবার সৌদি আরবে গেলেও প্রিন্স ফয়সালের সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করিনি। তিনি ব্যস্ত মানুষ। তখন সাক্ষাৎ করলে আমার জন্য হয়তো কিছুটা খারাপও হতে পারত অন্য কারণে। আমি এসআইবিএলের চার শ’ পল্লী শাখা করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তখন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, আমি নাকি সৌদি আরব থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এনে বাংলাদেশে ইসলামী বিপ্লব করার চেষ্টা করছি। অথচ বিদেশ থেকে ব্যাংকের জন্য আমি যত বিনিয়োগ এনেছি তার পাই-পয়সা পর্যন্ত হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা একসময় তাদের বিনিয়োগ লাভসহ তুলে নিয়ে গেছেন। কোথাও কোনো অনিয়ম হয়নি। এটাই আমার আত্মতৃপ্তি।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com