পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন জটিলতায় ভবিষ্যত নষ্ট

এম এ কাদের | Mar 06, 2020 08:56 pm
পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন জটিলতায় ভবিষ্যত নষ্ট

পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন জটিলতায় ভবিষ্যত নষ্ট - সংগৃহীত

 

সব পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে প্রতি বছর কত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে, সে হিসাব কারো জানা নেই। এতে বহু শিক্ষার্থীর জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার খাতা (এসএসসি ও এইচএসসি) অবমূল্যায়ন করার ঘটনা কম নয়। ২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় সারা দেশে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৫০৫ জন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ২৯ হাজার ১২৯ জন, এর মধ্যে খাতা কল হয় ২৩ হাজার ১২৩ জনের। ঢাকা বোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিল তিন লাখ ৯৩ হাজার ৮৩৫ জন, খাতা কল হয় ৫২ হাজার ৯০০ জনের। ফল পরিবর্তন হয়েছে এক হাজার ৫৮৬ জনের।

শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে ভালো পরীক্ষা দেয়ার পরও খাতা অবমূল্যায়নের ভয়ে উদ্বিগ্ন দিন কাটায়, তাদের খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে কি না। শিক্ষার্থীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি বোর্ড পরীক্ষার খাতা নানা কারণে অবমূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। যেমন- অদক্ষ পরীক্ষক দিয়ে মূল্যায়ন, সঠিক নিরীক্ষণ না করা, পরীক্ষক নিজ হাতে মূল্যায়ন না করা, স্বল্পসময়ে বেশি খাতার মূল্যায়ন, পরীক্ষার উত্তরপত্র ভালোভাবে না পড়ে নিছক অনুমানের ওপর নম্বর দেয়া, পরীক্ষক মূল্যায়নের সময় পারিবারিক বা অন্য কাজে মনোযোগ দেয়া, মূল্যায়নের সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারি না থাকা, পরীক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকা, দুর্বল শিক্ষার্থীর সাথে ভালো শিক্ষার্থীর খাতা মিশে যাওয়া, পরীক্ষার মূল খাতার সাথে লুজ শিট সুতা দিয়ে সেলাই না করে পিন দিয়ে আটকানো, খাতা অবমূল্যায়নে শাস্তির বিধান না থাকা, পুনর্মূল্যায়নে (কল) সহজ পন্থা না থাকা, পরীক্ষকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা প্রভৃতি।


একজন শিক্ষার্থী নার্সারি-প্লে ক্লাস থেকে শুরু করে ১২ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনা করে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। এই ১২ বছরের প্রতি মিনিটের প্রচেষ্টার সুফল নির্ভর করে পরীক্ষার ফলের ওপর। কিন্তু কোনো কারণে পরীক্ষকের অবহেলা, গাফিলতি বা সঠিক নিয়ম না ঘটলে পরীক্ষার খাতার অবমূল্যায়ন ঘটে। এতে ওই শিক্ষার্থীর যে মারাত্মক ক্ষতি হয়; তা কোনোভাবে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কাজেই তাচ্ছিল্য করে বা যেনতেনভাবে খাতা মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। তাই অদক্ষ পরীক্ষককে খাতা মূল্যায়ন করার সুযোগ দেয়া অনুচিত। কমপক্ষে ১০ বছর, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা থাকা বাঞ্ছনীয়। অভিজ্ঞ পরীক্ষক দিয়ে খাতা মূল্যায়নের পর জবাবদিহিমূলক প্রধান পরীক্ষকের ১৩ শতাংশের স্থলে ২৫ শতাংশ খাতা সঠিকভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষক নিজে খাতা মূল্যায়ন না করে বাসার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, স্বজন, বন্ধু, এমনকি প্রাইভেট পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করে থাকেন। এতে শিক্ষার্থীর খাতা একেবারেই মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু অনুমান করে বা পাতা গুনে নম্বর দেয়া হয়। এটা প্রমাণিত হলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে।

একজন পরীক্ষককে ৩০০ খাতা দেখতে মাত্র ১৫ দিন সময় দেয়া হয়, যা কোনোভাবে যথেষ্ট নয়। একটি খাতা মূল্যায়নে ৩০ মিনিট হিসাবে ৩০০ খাতা দেখতে কমপক্ষে ১৫০ ঘণ্টা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে সময়ের অভাবে তাড়াহুড়া করে বা অনভিজ্ঞদের দিয়ে খাতা মূল্যায়নের দরুন সঠিক মূল্যায়ন হয় না। এ জন্য একসাথে একজন পরীক্ষককে ৩০০ খাতা দেয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। আর যদি দিতেই হয়; তা হলে অবশ্যই তাদের সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। অনেক পরীক্ষক উত্তরপত্র সঠিকভাবে না পড়েই অনুমানের ওপর দাগ দিয়ে পাতা উল্টিয়ে যান এবং মনগড়া নম্বর দেন। ফলে একজন ভালো শিক্ষার্থীরও বড় ক্ষতি হতে পারে। প্রতিটি বাক্য পড়ে খাতা মূল্যায়ন করা জরুরি। খাতা মূল্যায়নে অবশ্যই নিরিবিলি পরিবেশ বেছে নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, ইউনিয়ন পরিষদে, উপজেলা পরিষদ হলরুমে অভিজ্ঞ দায়িত্বশীল কর্মকর্তার উপস্থিতিতে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা। এতে কোনো খাতার ব্যাপারে সমস্যা দেখা দিলে আলোচনা করে সমাধান করা সহজ হবে।

খাতা মূল্যায়নে বোর্ড থেকে বণ্টনের পর, পরীক্ষকদের সাথে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিবিড় তদারকি থাকতে হবে। শিক্ষার্থীর পরীক্ষার সিট প্ল্যানে অধিক দুর্বল শিক্ষার্থীর সাথে ভালো পরীক্ষার্থীর খাতা মিশে খাতা অবমূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। পরীক্ষক পরপর কম নম্বর পাওয়া খাতা মূল্যায়ন করতে করতে মন-মানসিকতা এক ধাঁচে তৈরি হয়ে যায়। এ কারণে কম নম্বর পাওয়া খাতার সাথে মিশে গেলে অনেক ভালো শিক্ষার্থীর খাতাও অবমূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। অথচ পরীক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিটি খাতার প্রত্যেকটি লাইন পড়েই মূল্যায়ন করা। পরীক্ষার মূল খাতার সাথে লুজ শিট সুতা দিয়ে সেলাই না করে অনেক ক্ষেত্রে পিন মেরে দেয়া হয়। এ পিনের মাথা অল্প আটকানো হলে অনেক খাতার চাপে লুজ শিট খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কোনোভাবেই সেলাই ছাড়া লুজ শিটে পিন মারা উচিত নয়।


এ ছাড়া সহজ শর্তে পুনর্মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শুধু নম্বর যোগ করে নয়, প্রথম মূল্যায়িত নম্বর লিখে রেখে খাতায় দেয়া প্রতিটি নম্বর ফ্লুইড দিয়ে মুছে আবার ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দায়িত্বে এবং মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে মূল্যায়ন করার পদক্ষেপ নেয়া অতীব প্রয়োজন। পুনর্মূল্যায়নেও অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর অভিযোগ থাকলে প্রয়োজনে দ্বিগুণ ফি জমা নিয়ে তার উপস্থিতিতে বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমানে পরীক্ষককে একটি খাতা মূল্যায়নের জন্য ২৫ টাকা দেয়া হয়। এটি খুবই কম। অবশ্যই প্রতিটি খাতা মূল্যায়নে পারিশ্রমিক যুক্তিসঙ্গতভাবে বাড়াতে হবে এবং অভিজ্ঞ পরীক্ষকদের বেশি পারিশ্রমিক দিতে হবে।

শিক্ষা যেখানে জাতির মেরুদণ্ড; সেখানে অপরিকল্পিতভাবে খাতা মূল্যায়ন করার কোনো যুক্তি নেই। অপরিকল্পিত কারিকুলামে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ১২টি ১১৫০ মার্কের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে, সৃজনশীল সাত সেট ও নৈর্ব্যক্তিক (টিক) ৩০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে শিক্ষার্থীকে গোটা বইয়ের প্রতিটি শব্দই মুখস্থ রাখতে হয়। এমনও দেখা গেছে, একজন শিক্ষার্থী রাত-দিন ২৪ ঘণ্টার ১৭-১৮ ঘণ্টা পড়েও সিলেবাস শেষ করতে পারছে না। এত বড় সিলেবাসে কোনো শিক্ষার্থী যদি ভালো ফল করতে বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে তার জীবন থেকে আনন্দ, বিশ্রাম, খেলাধুলা, এমনকি পারিবারিক অনুষ্ঠান বাদ দেয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। শরীর সুস্থ রাখতে প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজন; তাও তার জীবন থেকে বিদায় নেবে। এই কারিকুলামে প্রতিটি সন্তানের সচেতন মা তার সন্তানের মানসিক অবস্থা, স্বাস্থ্য নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দুর্ভাবনার বিষয়। এর পরও পরীক্ষকের অবহেলায়, অনিয়মে উত্তরপত্রের যদি অবমূল্যায়ন হয়, তাহলে ওই শিক্ষার্থীর ও অভিভাবকদের সান্ত্বনা পাওয়ার আর কিছু থাকে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা করে চলতে হবে। অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করে পরীক্ষার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর পরিশ্রম সার্থক এবং উচ্চ শিক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ জোগাতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us