সিরিয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে তুর্কি বাহিনী

তুর্কি ট্যাঙ্ক - সংগৃহীত
সিরিয়ায় বেশখানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ সর্বাত্মক ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্ক। এই যুদ্ধে ব্যর্থতার পরিণতি এরদোগানের জন্য দেশটির বাইরের পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ হারানো পর্যন্ত সীমিত থাকবে না। একই সাথে তুর্কি বাহিনীর যেকোনো পরাজয় দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণও হতে পারে। ফলে এরদোগানকে এখন প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে ভেবেচিন্তে। এই পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সাথে সম্পর্কের বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে রয়েছে রাশিয়ার সাথে কয়েক বছর ধরে গড়ে ওঠা সহযোগিতার সম্পর্ক এগোবে নাকি তাতে অচলাবস্থা তৈরি হবে সেই প্রশ্নও।
এ লেখাটি যখন লিখছি সেদিনই রাশিয়ায় রুশ প্রেসিডেন্টের সাথে তুর্কি নেতা এরদোগানের বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এই বৈঠকের ফলাফলের ওপর সিরিয়ায় শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনেকখানি নির্ভর করে। এই বৈঠক ব্যর্থ হলে রাশিয়ার কাছ থেকে এস৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় এবং পরমাণু বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা অব্যাহত থাকার বিষয়টি সামনে চলে আসবে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে অনেকের ধারণা, পুতিন অথবা এরদোগান কেউই চান না দুই দেশ প্রত্যক্ষ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক অথবা চলমান সমঝোতার সম্পর্ক ভেঙে পড়ুক। যদিও ইদলিবে তুর্কি সেনা নিহত হওয়ার পর দুই নেতার মধ্যে টেলিফোনে নজিরবিহীন উত্তপ্ত ভাষায় কথাবার্তা হয়েছে। এ সময় এরদোগান পুতিনকে বলেছেন, আসাদ বাহিনীর কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে, তুরস্ক তাকে শায়েস্তা করবে। আর পুতিন জবাবে বলেছেন ইদলিব থেকে সরে যেতে। এর পর আসাদ বাহিনীর অবস্থান থেকে রাশিয়া কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেছে আর তুরস্ক সিরিয়ান সরকারি অবস্থানে ব্যাপক হামলা চালিয়ে দুই সহস্রাধিক সরকারি সেনা ও হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াকে হত্যা করেছে। কিন্তু ইদলিবকে সিরিয়ার সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগে রুশ বিমান সহায়তা অব্যাহত রয়েছে।
সিরিয়ার বাস্তবতা হলো, সেখানে আরব বসন্তের জের ধরে বাশার আসাদের সরকারকে উচ্ছেদ করার প্রথম গণবিক্ষোভ এবং এরপর সশস্ত্র লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তিগুলো আসাদবিরোধীদের কাছ থেকে নিজেদের আস্তে আস্তে গুটিয়ে নেয়। রাশিয়া বাশার আসাদ বাহিনীর সহায়তায় সর্বাত্মকভাবে মাঠে নামে। সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে সাথে থাকে ইরান। অন্য দিকে সিরিয়ার সাথে ভৌগোলিকভাবে সংলগ্ন তুরস্কের সামনে সিরিয়া থেকে হাত গোটানোর মতো অবস্থা থাকেনি। প্রায় ৪০ লাখ সিরীয় শরণার্থী আশ্রয় নেয় তুরস্কে। এত বিপুল শরণার্থীর বোঝা তুর্কি অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে। এরদোগানের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার ফলে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারা দু’টি সিটি করপোরেশনে একসাথে ক্ষমতাসীন দল একে পার্টি হেরে যায়।
এ অবস্থায় এরদোগানের কৌশল থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বলয়ে থেকেই রাশিয়ার সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে সিরিয়ায় একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বের করা। এই কৌশলের অংশ হিসেবে এক দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী দেশগুলোর সাথে সিরীয় পরিস্থিতি নিয়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে তুরস্ক। অন্য দিকে রাশিয়া ও ইরানের সাথে আস্তানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় সোচি চুক্তি হয়েছে রাশিয়ার সাথে আর তুর্কি সীমান্তবর্তী কুর্দি অঞ্চলগুলোতে বাফার জোন প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে চুক্তি করেছে আঙ্কারা।
তুরস্কের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য সিরীয় পরিস্থিতি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়ে আসছিল এক দশক ধরে। দেশটি আরব বসন্তে গণতন্ত্রকামীদের পক্ষে ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আরব বসন্তের গণবিক্ষোভ কয়েকটি দেশে শান্তিপূর্ণ না থেকে সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়। সিরিয়া হলো তেমন একটি দেশ, যেখানে জনসংখ্যার প্রতি ২০ জনে একজন গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছে। এই পরিস্থিতির নতুন করে অবনতি ঘটেছে বাশার আসাদের বাহিনী ইদলিব দখলে নতুন পর্যায়ের অভিযান শুরু করার ফলে।
ইদলিব হলো আসাদবিরোধী পক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ। যেটি ভৌগোলিকভাবে তুরস্কের সাথে সংযুক্ত। ইদলিব সরকারি বাহিনীর দখলের অর্থ হবে কয়েক লাখ মানুষের জীবন হানি এবং ২০ লাখ মানুষের নতুন করে শরণার্থী হওয়া। এর মধ্যে ১০ লাখ সিরীয় জীবন বাঁচাতে তুরস্ক সীমান্তে সমবেত হয়েছে। তুরস্ক চেয়েছিল রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ইদলিবে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে। এই স্থিতাবস্থার জন্য তুরস্ক সোচি চুক্তির আওতায় তার সামরিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে।
সর্বশেষ ইদলিবে যে সঙ্ঘাত দুই পক্ষের মধ্যে হয়েছে, তাতে সোচি চুক্তির ব্যাখ্যা নিয়ে বেশ ব্যবধান লক্ষ করা যাচ্ছে। রুশ বিশ্লেষকরা বলছেন, সোচি চুক্তি অনুসারে কোনো সশস্ত্র গ্রুপের কাছে হস্তচালিত বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের কথা নয়। একটি সিরীয় সরকারি বিমান ভূপাতিত করার ক্ষেত্রে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আর সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হামলায় যেসব তুর্কি সেনা নিহত হয়েছে তারা সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর অবস্থানের সাথেই ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। অন্য দিকে তুরস্কের বক্তব্য হলো, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছার আগে ইদলিবে বাশার বাহিনীর সামরিক অভিযানের অর্থ হবে সেখানে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় ঘটানো এবং নতুন করে ৩০-৪০ লাখ শরণার্থীর তুরস্কের দিকে যাত্রা করা। ৪০ লাখ শরণার্থীর বড় বোঝার পাশাপাশি এই সমস্যার সমাধান না করে নতুন সঙ্কট চাপিয়ে দেয়া কোনোভাবেই তুরস্ক মেনে নিতে পারে না। আর সোচি চুক্তি অনুসারে তুর্কি যেসব পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে, সেখানকার সেনা সদস্যদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা সুস্পষ্টভাবে লাল রেখা লঙ্ঘন। কোনোভাবে এটি আঙ্কারা মেনে নিতে পারে না।
এ ঘটনার পর তুরস্ক সিরীয় বাহিনীর ওপর যে আঘাত ও প্রতিজবাব দিয়েছে, তাতে এরদোগান এখন পর্যন্ত জয়ের ধারায় রয়েছেন। তবে সেখানে সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণ ভারসাম্য এখন আর নেই। সিরিয়া এবং তুর্কি বাহিনীর সামরিক অবস্থান এখন একে অন্যের জন্য বৈধ টার্গেট হিসেবে বিবেচনা করছে। এ নিয়ে এরদোগান-পুতিন বৈঠকে কোনো সমঝোতা না হলে সিরিয়া একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। আর এটি হলে তুরস্কের সাথে ন্যাটোও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ হোক অথবা পরোক্ষভাবে হোক তুরস্কের পেছনে দাঁড়াবে। রাশিয়া এবং ইরানের সাথে তুরস্কের সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্ক আর থাকবে না। এর পরিণতিতে একটি সর্বাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধ এমনকি বিশ্বযুদ্ধেরও সূচনা ঘটতে পারে।
এ ধরনের একটি পরিণতি সম্ভবত রাশিয়া অথবা তুরস্ক- কেউ চাইছে না। আর এ কারণে অধিকতর বিপর্যয়ের আগেই রাশিয়া ও তুরস্কের দুই নেতা বৈঠকে মিলিত হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।