যেভাবে হিসাব বদলে গেল মালয়েশিয়ায়
মাহাথির, আনোয়ার ও মুহিউদ্দিন - সংগৃহীত
মালয়েশিয়ায় সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে একের পর এক অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। এর সর্বশেষ ঘটনা হলো, ডা: মাহাথির মোহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত দল বারাসাতুর দ্বিতীয় প্রধান নেতা মুহিউদ্দিন ইয়াসিন সাবেক শাসক দল উমনু এবং ইসলামী দল পাসের সাথে মিলে এক রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এর জের হিসেবে দেশটির রাজা মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে মালয় দলগুলোর নতুন জোট সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে কাজ চলে আসছিল তার পরিণতি দিয়েছেন। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়ে চূড়ান্ত নাটকটি মঞ্চস্থ করেছেন মাহাথিরের দ্বিতীয় প্রধান নেতা মুহিউদ্দিন ইয়াসিন আর আনোয়ার ইব্রাহিমের দ্বিতীয় প্রধান নেতা আজমিন আলী। এর মধ্যে প্রথমজন মাহাথিরের সামনে পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার মুলা ঝুলিয়েছেন আর আজমিন আলী মাহাথিরের দৃশ্যত পক্ষ নিয়ে দলের ভেতরে আনোয়ারের সাথে প্রকাশ্য লড়াইয়ে নেমেছেন। এর সাথে মালয় ভূমিপুত্রা রাজনীতির বিশিষ্ট ধারক রইস ইয়াতিম, দায়েম জয়েন উদ্দিনসহ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন। তাদের সাথে সুলতানদের কারো কারো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রধানত যে বক্তব্য সামনে আনা হয় তা হলো চীনা দলগুলো মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে প্রভুত্ব বিস্তার করতে শুরু করেছে আর আনোয়ারের নেতৃত্বে পাকাতান হারাপান ক্ষমতায় থাকলে সেই নিয়ন্ত্রণ আরো শেকড় বিস্তার করবে। সুতরাং মালয়দের যেভাবেই হোক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হবে।
মালয়েশিয়ায় যে জাতিগত ভারসাম্য রয়েছে তাতে ৬০ শতাংশ হলো মালয়, ২৭ শতাংশ চীনা এবং ৮ শতাংশের মতো ভারতীয় বংশোদ্ভূত; যারা প্রধানত তামিল। চীনারা বরাবরই দেশটির অর্থনীতি শিল্প ও বাণিজ্যের ওপর আধিপত্য বজায় রেখে আসছিল। মালয়রা প্রভাব বজায় রেখে আসছিল রাজনীতির ওপর। ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা সব সময় চীনাদের সাথে থাকত। এ অবস্থায় স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কোনো সরকারে মালয় আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো কোনো দল বা নেতা ক্ষমতায় আসেনি। ২০ মাস আগে মাহাথিরের নেতৃত্বে যে পাকাতান হারাপান দল ক্ষমতায় আসে, সেই সংসদে শাসক জোটের মালয় এমপির প্রায় কাছাকাছি ছিল অ-মালয় এমপি। এই জোট ক্ষমতায় আসার পর মালয় একাধিপত্য কিছুটা ক্ষুণ্ন হয় বলে মনে করা হয়। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী মালয় হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় যায় অ-মালয়ের হাতে। অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ করা হয় অ-মালয় থেকে। প্রচারণা চালানো হয় যে, মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী থেকে বিদায় হওয়ার পর আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হলে সেই ভারসাম্য একেবারেই থাকবে না। আর এই ভীতি সামনে রেখে অভ্যুত্থানের বিষয়টি মঞ্চস্থ করতে উমনু পাস মুহিউদ্দিনের বারসাতু আর আজমিনের পিকেআর গ্রুপ বিকল্প সরকারের গঠনের চেষ্টাকে এগিয়ে নেয়। শেষোক্ত দুই গ্রুপ মিলে হারাপান থেকে বেরিয়ে এসে জোট সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ভারসাম্য দুটোই ভেঙে দেয়। এ ধরনের একটি বিষয় মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে মাহাথিরের নাম ব্যবহার করা হলেও তিনি বিষয়টির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি যখন পুরো বিষয়টি জানতে পারেন তখন সব কিছু তার হাত থেকে বেরিয়ে যায়।
উমনু পাস তার পেছন থেকে সরে গিয়ে মুহিউদ্দিনকে রাজার সামনে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করে আর পাকাতান হারাপান প্রথমে আনোয়ারকে এবং পরে মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য রাজার সামনে প্রস্তাব দেয়। মালয়েশিয়ার সুলতানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরও মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী না করে মুহিউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন রাজার মাধ্যমে। তারা মনে করেছেন, ভেঙে যাওয়ার পরে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন পাকাতান সরকার গঠন হলে সেখানে অ-মালয় এমপিরা হবেন সংখ্যাধিক এবং বিকল্প জোটকে ক্ষমতায় আনা হলে মালয় আধিপত্য বজায় থাকবে। এই অভ্যুত্থানের পুরো ঘটনাকে মাহাথির তার সাথে মুহিউদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আগামী ৯ মার্চ ছিল নতুন সরকারের আস্থা ভোট করার দিন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থন না থাকায় এই তারিখ মে মাসের শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন সরকার গঠনও নানা টানাপড়েনের কারণে খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। নতুন সরকারের সাথে দল ভাঙার ষড়যন্ত্রকারীরা এক হওয়ায় সবাই যার যার স্বার্থ নিশ্চিত করতে চাইবেন। আজমিন আলী উপপ্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। উমনু থেকে বলা হচ্ছে, তারা সরকারে সবচেয়ে বড় দল, তাদের দল থেকে উপপ্রধানমন্ত্রী করতে হবে। এ নিয়ে উমনুর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকার গঠনের পর বিরোধ-বিসম্বাদ আরো বাড়তে পারে। বঞ্চিতরা হাত মেলাতে পারে বিরোধী পক্ষের সাথে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থন লাভ চ্যালেঞ্জের হতে পারে মুহিউদ্দিনের জন্য। আবার মাহাথির বা আনোয়ারের নেতৃত্বে সরকার গঠন হবে কি না, সেটিও অনিশ্চয়তায় ভরা। মুহিউদ্দিন সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে মালয় শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা সুলতানদের কাছে নতুন নির্বাচন দেয়ার প্রস্তাব দিতে পারে। আর তাতে উমনু-পাস যে জোট গঠন হয়েছে তারা ভালো করার ব্যাপারে আশাবাদী। তবে এসব রাজনৈতিক ক্ষমতার নোংরা খেলা রাষ্ট্রের স্থিতি গণতন্ত্র ও অর্থনীতি সুখকর হয় না।
mrkmmb@gmail.com