বর-কনে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইসলামি বিধান
বর-কনে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইসলামি বিধান - ছবি : সংগ্রহ
বিয়ে নারী-পুরুষের নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষাকারী এবং মানব বংশের ধারা সুষ্ঠুরূপে অব্যাহত রাখার একমাত্র উপায়। বিয়ে হলো একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে নিষ্পন্ন বৈধ বন্ধন ও সামাজিক চুক্তি। বিয়ে এমন একটি চিরাচরিত প্রক্রিয়া যা সৃষ্টির আদি থেকে চলমান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ধর্মভেদে এর বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও বিয়ের মূল উদ্দেশ্য ও পরিচয় এটিই। বিয়ে একটি বৈশ্বিক সার্বজনীন নিয়ম, যা পৃথিবীর সব দেশে সব ধর্মে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টিকেই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। এবং বিয়ে করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন ‘তোমাদের মধ্যে যাদের স্বামী-স্ত্রী নেই, তাদের বিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে, আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নূর, আয়াত ৩২)
রাসূল সা: বলেন ‘হে যুবকরা! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে এবং যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না সে যেন ‘সওম’ পালন করে। কেননা, সওম যৌন ক্ষমতাকে দমন করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৫০৬৫)
দাম্পত্যজীবনের সূচনা হয় বিয়ের মাধ্যমে। একটি আদর্শ, সুন্দর ও সুখী দাম্পত্যজীবনের জন্য বিয়ের আগে বেশ কিছু করণীয় রয়েছে । এসব উপেক্ষা করে জীবনে সুখী হওয়া সম্ভব নয়। বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর যে বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে তার মধ্যে ‘কুফু’ অন্যতম।
আরবি ‘কুফু’ শব্দের অর্থ সমতা, সমান, সাদৃশ্য, সমকক্ষ, সমতুল্য ইত্যাদি। বিয়ের ক্ষেত্রে বর-কনের রুচি, চাহিদা, বংশ, যোগ্যতা সব কিছু সমান সমান বা কাছাকাছি হওয়াকে ইসলামী পরিভাষায় কুফু বলে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের রুচি, চাহিদা, অর্থনৈতিক অবস্থান খুব বেশি ভিন্ন হলে সেখানে সুখী দাম্পত্যজীবন প্রতিষ্ঠা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
একজন উচ্চ শ্রেণীর ছেলেমেয়ের চাহিদা-রুচির সাথে একজন দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ের রুচিবোধের মিল না থাকাটাই স্বাভাবিক। আবার একজন দ্বীনদার পাত্রপাত্রীর সাথে একজন ধর্মবিষয়ে উদাসীন পাত্রপাত্রীর জীবনাচার নাও মিলতে পারে। দ্বীনদার চাইবে সব কিছুতে ধর্মের ছাপ থাকুক। আর দীনহীন চাইবে সব কিছু ধর্মের আবরণমুক্ত থাকুক। সুতরাং এ দুইয়ের একত্রে বসবাস কখনো শান্তি-সুখের ঠিকানা হতে পারে না। তাই পবিত্র কুরআনও বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বীনদারিতে সমতা রক্ষার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে।
আল্লাহ বলেন, ‘দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য; দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্য; সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য উপযুক্ত।’ (সূরা নূর : ২৬)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ব্যভিচারী পুরুষ যেন ব্যভিচারিণী বা মুশরিক নারী ছাড়া কাউকে বিয়ে না করে। আবার ব্যভিচারিণী নারী যেন ব্যভিচারী পুরুষ বা মুশরিক পুরুষ ছাড়া কাউকে বিয়ে না করে। মুমিনদের জন্য এ ধরনের চরিত্রের নারী-পুরুষকে হারাম করা হয়েছে।’ (সূরা নূর : ৩)।
কুরআনের পাশাপাশি রাসূল সা:-এর পবিত্র হাদিস শরিফেও ‘কুফু’ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। রাসূল সা: ‘কুফু’র বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। রাসূল সা: বলেছেন,‘ তোমরা যে ব্যক্তির দ্বীনদারী ও নৈতিক চরিত্রে সন্তুষ্ট আছ তোমাদের নিকট সে ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব করলে তবে তার সাথে বিয়ে দাও। তা যদি না কর তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ ও চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস নং ১০৮৪)।
তিরমিযি শরিফের আরেকটি হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, রাসূল সা: হজরত আলী রা:-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন ‘হে আলী! তিনটি ব্যাপারে দেরি করো না। নামাজ যখন তার ওয়াক্ত আসে, জানাজা যখন উপস্থি হয় এবং যখন তুমি তার উপযুক্ত পাত্র পাও’’ (তিরমিজি, হাদিস নং ১৭১) । আরেক হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বার্থে উত্তম মহিলা গ্রহণ করো এবং সমতা (কুফু) বিবেচনায় বিয়ে করো, আর বিয়ে দিতে সমতার প্রতি লক্ষ্য রাখো’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৯৬৮)। এ রকম আরো কিছু হাদিস উদ্ধৃত করে ইমাম শাওকানি রা: মন্তব্য করেছেন, ‘এসব হাদিস স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, দ্বীনদারী ও চরিত্রের দিক দিয়াই ‘কুফু’র বিবেচনা করতে হবে। ইমাম মালেক দৃঢ়তার সাথে বলেছেন ‘কুফু’র ব্যাপারটি কেবলমাত্র দ্বীনদারীর ক্ষেত্রেই বিবেচ্য। (নায়লুল আওতার)।
বস্তুত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালোবাসা ও দাম্পত্য জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করাই ‘কুফু’র মুখ্য উদ্দেশ্য। কনে যদি দ্বীনদার ও পবিত্র চরিত্রের হয় আর বর যদি বেদ্বীন-চরিত্রহীন হয় কিংবা এর বিপরীত হয়, তাহলে অন্য সব দিক দিয়ে সমতা হলেও সে মিল শরিয়তের দৃষ্টিতে কাম্য নয়।
তেমনি এ ধরনের বিয়ে স্থিতিশীল নাও হতে পারে। হলেও সে দাম্পত্য জীবন হতে পারে তিক্ত ও বিষাক্ত।
লেখক : নিবন্ধকার