কত টাকা পাচার হয়েছে?
টাকা - সংগৃহীত
সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন বন্ধ ও পাচার হওয়া অর্থের তথ্য আদান-প্রদান করতে ৭৭টি দেশের সাথে চুক্তি করেছে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর বাইরেও আন্তর্জাতিক সংগঠন এগমন্ড-৩ গ্রুপের সদস্য হিসেবে ১৬৪টি দেশের সাথে এ সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে বাংলাদেশ; কিন্তু এর পরেও দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ হচ্ছে না; বরং দিন দিন অর্থপাচার বেড়েই চলছে। কারা এ অর্থ পাচার করছে, কোন দেশে পাচার করা হচ্ছে তারও পূর্ণাঙ্গ কোনো পরিসংখ্যান নেই। অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় অন্যরাও দেশ থেকে অর্থপাচারে উৎসাহিত হয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এটা অব্যাহত থাকলে কাক্সিক্ষত হারে দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি হবে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় কাক্সিক্ষত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। বাড়বে বেকারত্বের হার। দেশের চাহিদা পূরণে বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাবে, যা দেশের জন্য মোটেও সুখকর হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক অর্থপাচারবিরোধী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) গত মঙ্গলবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচারের ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। প্রতিবেদনে রয়েছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা
জিএফআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা: রাজী হাসান গতকাল এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানান, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হয়, এটা ঠিক। তবে জিএফআই থেকে অর্থপাচারসংক্রান্ত যে তথ্য পরিবেশন করা হয়, তা স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু অর্থপাচারের তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে কিছু মামলাও দায়ের করা হয়েছে। আর মামলা করার বিষয়টি সংস্থাটির প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি জানান, পাচারকৃত অর্থের তথ্য আদান-প্রদান করতে বিএফআইইউ পর্যন্ত বিশ্বের ৭৭টি দেশের সাথে এমওইউ করেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হিসেবে ১৬৪টি দেশের সাথে তারা অর্থ লেনদেন করতে পারে। বিএফআইইউ থেকে টাকা পাচারসংক্রান্ত তথ্য লেনদেন করতে সব সময় সচেষ্ট রয়েছে।
দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার প্রভাব ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এর আগে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) রয়েছে। তাদের ব্যাংকিং খাতে সন্দেহজনক লেনদেন তদারকি করার কথা। মানিল্ডারিং প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা রয়েছে; কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু চোখে পড়ে না। আগে ব্যাংকগুলোকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে ও সন্দেহজনক লেনদেন বন্ধে কঠোর তদারকির মধ্যে রাখা হতো। প্রায় প্রতি মাসেই এ জন্য ব্যাংকগুলোকে জরিমানা করা হতো; কিন্তু এখন আর তা শোনা যায় না। সাবেক এ গভর্নর বলেন, মানিল্ডারিং প্রতিরোধে ব্যাংকগুলোকে কঠোর তদারকির মধ্যে রাখতে হবে। বিএফআইইউকে আরো শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে ইতোমধ্যে যেসব টাকা পাচার হয়ে গেছে, তা ফেরত আনার জন্য সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে না পারলে টাকার পাচারকারীরা আরো উৎসাহিত হবে। অন্যরাও পাচারে উৎসাহিত হবে, যা দেশের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা খুবই জটিল প্রক্রিয়া। মূলত দুই প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রথমত, অর্থপাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলা করতে হবে। স্থানীয় আদালত পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় দিতে হবে। আদালতের এ রায়েয় কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস অর্থ ফেরত দেয়া যায় কি না মর্মে তা ওই দেশের আদালতে মামলা করবে। সংশিষ্ট দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জলিতা রয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করবে। যদি পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরেই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সব কিছু অনুকূলে থাকলে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্থ ফেরত আনতে পাঁচ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। সুতরাং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কথাবার্তা বলা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা ছাড়া বৈ অন্য কিছু নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
দ্বিতীয়ত, মামলা করা ছাড়াও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়, যদি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি কোনো জটিলতা না থাকে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হতে হবে। যেমন বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র এগমন্ড গ্রুপের সদস্য। এ ক্ষেত্রে এক দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অন্য দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে সংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট নম্বরসহ সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করতে হবে। ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। যাচাই-বাছাইয়ে তথ্য গরমিল না পেলে কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে এ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।