করোনা নিয়ে তসলিমার বক্তব্যে তোলপাড়
করোনা নিয়ে তসলিমার বক্তব্যে তোলপাড় - ছবি : সংগ্রহ
‘ভাইরাস’ শব্দটি আমরা প্রায়ই শুনি। বিশেষ করে ডাক্তারদের কাছে বেশি শোনা যায়। সর্দিকাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে জ্বরের লক্ষণ দেখে বলেন, সাধারণ ভাইরাস জ্বর। এ জ্বর ৩-৪ দিন পর ভালো হয়ে যায়। ভাইরাস আসলে এক ধরনের সংক্রামক রোগের জীবাণু, যা হাঁচি কাশির মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়ায়। এজন্য মুখে রুমাল বা অন্য কোনো কিছু চেপে হাঁচি কাশি দিতে বলা হয়, যাতে হাঁচি কাশির ভেতরে থাকা রোগের জীবাণু বাতাসে ছড়াতে না পারে। কারণ বাতাসে ছড়ালে সেই বাতাস নিঃশ্বাসের সাথে অন্য কেউ গ্রহণ করলে সেও আক্রান্ত হয়। এ কারণে সবাইকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে যে ভাইরাসটি সমগ্র বিশ্বকে আতঙ্কিত করেছে তার নাম করোনাভাইরাস। পুরো নাম নভেল করোনাভাইরাস। চীন দেশের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে জানা যায়। এ ভাইরাস কিভাবে ছড়াল, কিসের মাধ্যমে ছড়াল সে বিষয়ে নানাজন নানা কথা বলছেন। কেউ বলছেন, চীনারা নানা জাতের পোকামাকড়সহ সবকিছুই খায়। তেলাপোকা, ফড়িং, কুকুর, বাদুর, নানা ধরনের পোকা সবই তাদের খাদ্য। নানা ধরনের, নানা আকৃতির সাপের মাংসও তাদের প্রিয় খাদ্য। করোনাভাইরাসের বদৌলতে বিশ্ববাসী এসব খাদ্য ব্যাপকভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে।
অনেকের ধারণা, এসব খাদ্যের মাধ্যমেই ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। কেউ কেউ বলছেন, বাইরের কোনো দেশের সংরক্ষণাগার থেকে এ বিষ চীনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ আবার বলছেন, চীনেরই জীবাণু সংরক্ষণাগার থেকে অসতকর্তার কারণে ছড়িয়ে পড়েছে এ জীবাণু। দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বিশ্বের অনেকগুলি দেশে ছড়িয়েছে বলে জানা গেছে। এই ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ বলছেন, ‘তেমন ভয় পাবার কিছু নেই। কিছুটা সতর্ক থাকলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।’ কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলছেন ভিন্ন কথা। চীনে যেসব বিদেশী শিক্ষার্থী বসবাস করছেন তারা বলেছেন, পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে যা জানানো হচ্ছে তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা চীনের। মৃতের সংখ্যা যা বলা হচ্ছে তার চেয়েও বহুগুণ মরেছে এবং মরছে। চীন সরকার করোনাভাইরাস এবং ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা জানাচ্ছে না বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে।
এ খবর দিয়েছে বিবিসি, রয়টার্স এবং এএফপি। বাস্তব অবস্থা যাই হোক, করোনাভাইরাস যে চীনকে এবং সমগ্র বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে তা বিভিন্ন দেশের গৃহীত পদক্ষেপ থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। চীন সরকার যে এই ভাইরাস সামাল দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে তা তাদের গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর করোনা ঠেকাতে চীন তার বিভিন্ন শহরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এক শহর থেকে অন্য শহরের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশও নানাভাবে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ফলে সমগ্র বিশ্বের মানুষ মহাতঙ্কে বসবাস করছে। আতঙ্কের প্রধান কারণ এই ভাইরাসের ওষুধ আবিষ্কৃত না হওয়া, ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ না পাওয়া। এমন এক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এই ওষুধ আবিষ্কারের খবর আসছে। কিন্তু এসব খবরের বাস্তব কোনো ভিত্তি আছে বলে জানা যায়নি।
তবে ভারতের আয়ু মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে হোমিওপ্যাথি ও ইউনানি ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। আয়ুর্বেদ, ইউনানি এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিষয়ক আয়ু মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের নানা তথ্য প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আর্সেনিকাম অ্যালবাম ৩০ (Arsenicum album 30) কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। টানা তিন দিন খালি পেটে এই ওষুধ সেবন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যদি এ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এক মাস পর ওষুধটি আগের নিয়মে আবারো খেতে বলা হয়েছে।
কিন্তু এই খবরের প্রতিবাদ করেছেন ভারতে নির্বাসিত ও বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশের একটি দৈনিকে (১৩/২/২০) হোমিওপ্যাথিক সম্পর্কে বিষোদগার করেছেন। তিনি বলেছেন, হোমিওপ্যাথিক কোনো চিকিৎসাই নয়। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কোনো সভ্য দেশে থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন না। তার মতে, ভারত একটি অসভ্য দেশ। এ সব চিকিৎসাপদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত নয়। তার মতে, পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও দেখা গেছে এসব চিকিৎসা ব্যবস্থা ভুল। তিনি বলেছেন, সবাই নতুনকে গ্রহণ করে। সুতরাং পুরাতন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পরিত্যাগ করা উচিত!
তসলিমা নাসরিন বিতর্কিত লেখিকা। যা করেন প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে, তার সবই তিনি প্রকাশ করেন রসিয়ে রসিয়ে। নিজের সম্পর্কে এবং অন্যের সম্পর্কে তিনি যেসব কথা প্রকাশ করেন সেসব আপত্তিকর বলে অনেকে মনে করলেও তিনি তা মনে করেন না। এর কারণ তিনি একজন ডাক্তার। ডাক্তারের কোনো কিছু গোপন করতে নেই। তাহলে গোপন রোগসহ অনেক কিছুই কারো পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। এজন্য যৌনজীবন সম্পর্কেও তিনি ‘খোলামেলা’ কথা বলেন। নিজের সম্পর্কে যেমন বলেন, তেমনি অন্যের সম্পর্কেও বলেন। বলেন মিলনে তাকে সুখী করতে না পারার কথা। বলেন, কারা যৌনমিলনে অক্ষম কিংবা দুর্বল তাদের কথা। এতে নিজের মান-সম্মানের ক্ষতি হয়- এমনটি তিনি মনে না করলেও অন্যেরা মনে করেন, তাদের গোপন কথা ফাঁস করে দেয়া অন্যায়।
এছাড়া ধর্ম সম্পর্কেও তিনি নানা কটুকথা বলে মানুষের মন বিষিয়ে তোলেন। এজন্যই তিনি বিতর্কিত। সুতরাং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি করা তার জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি নিজে ডাক্তার নই। আমি আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একজন রোগী হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করতে পারি।
আমি একজন শিল্পকলার অতি সাধারণ শিক্ষার্থী। শিল্পকলা নিয়ে চর্চা করি, পড়ি এবং লিখি। এটাই আমার প্রধান কাজ। এর পাশাপাশি ধর্ম, চিকিৎসা, রাজনীতি এবং সমাজের কিছু বিষয় নিয়েও ভাবতে এবং জানতে চেষ্টা করি। আর এ কারণে বইও পড়ার চেষ্টা করি। এভাবেই হোমিওপ্যাথিক সম্পর্কে অতি সামান্য কিছু ধারণা লাভ করেছি। এই ধারণার সাথে তসলিমা নাসরিনের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাচ্ছি না। ১৭৯০ থেকে ১৭৯৬ সালের কথা। এই সময়কালের মধ্যে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে হ্যানিমেন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, মানব শরীরে যে ভেষজ বা ওষুধ কিংবা দ্রব্য রোগ সৃষ্টি করে সেই ভেষজই রোগ নিরাময় করতে সক্ষম। উল্লেখ্য, এ ওষুধ প্রকৃতিপ্রদত্ত। যাকে বলা হয়েছে- সমঃ সমং শময়তি (similia similibus coretur)।
আরো উল্লেখ্য, হ্যানিমেন নিজের ওপর সিঙ্কোনা নামক ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করে দেখেছেন যে, এতে করে এ ওষুধ প্রচ- রকম কম্পজ্বরের সৃষ্টি করে। আবার একই ওষুধ স্বল্পমাত্রায় ব্যবহার করলে সেই প্রচ- রকম কম্পজ্বর জাদুমন্ত্রের মতো অন্তর্নিহিত হয়ে জ্বরের কষ্ট লাঘব করে। অন্যদের কাছ থেকে জানা এবং আমার নিজের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। একবার পেটের পীড়ায় প্রায় এক বছর ভুগেছি। কোনো অ্যালোপেথিক ডাক্তারই উপশম করতে সক্ষম হননি। একসময় হোমিওগ্রন্থ পড়তে গিয়ে লক্ষ করলাম, আমার পেটের যেমন সমস্যা ঠিক তেমনি বর্ণনা রয়েছে এক স্থানে এবং ওইরূপ সমস্যার জন্য ওষুধের কথাও বলা হয়েছে। সেই ওষুধ কিনে সেবন করে এক সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলাম। জাদুমন্ত্রের মতোই কাজ করল সেই ওষুধ।
আরেকবার গলার সলিড ফর্মের গোয়েটার নিয়ে হাজির হলাম অ্যালোপেথিক চিকিৎসকের কাছে। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিলেন কেটে ফেলে দিতে হবে ওই গোয়েটার। কেটে ফেলাই নাকি একমাত্র উপায় অ্যালোপেথিক পদ্ধতিতে। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম অপারেশন করাতে। কিন্তু আমাকে হোমিও ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে একজন ডাক্তারের কাছে পাঠালেন। সেই ডাক্তারের হোমিও ওষুধ খেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম। গোয়েটার যেনো সম্পূর্ণরূপে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! সে প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। আজও আল্লাহর মেহেরবানিতে সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি হোমিওপ্যাথিতে যদি সঠিক মাত্রায় নির্দিষ্ট রোগের জন্য নির্ধারিত ওষুধ প্রয়োগ করা যায় তাহলে জাদুমন্ত্রের মতোই কাজ করে। কিন্তু অনেকেই সব কিছু সঠিক সময় সঠিকভাবে নির্ণয় করতে না পারায় ঠিক ওষুধটি সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে পারেন না বলেই সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং হোমিওপ্যাথিক অকার্যকর এ কথা বলার যুক্তি দেখি না। তাছাড়া তসলিমা বলেছেন, হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নয়, সে কথাও পুরোপুরি সত্য তা বলা যায় না।
কারণ হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে বলা হয়েছে, হ্যানিমেন শুধু এই নবপদ্ধতির প্রবর্তন করেননি, তিনি একে বিজ্ঞানের সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। হোমিওপ্যাথিক একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং এতে শুধু সাধারণ রোগই নয়, বরং জটিল রোগও আরোগ্য করা সম্ভব (হোমিওপ্যাথিক পেসান্টস গাইড, হোমিও রিসার্চ)।
ভারত চিকিৎসা ক্ষেত্রে অতি প্রাচীনকাল থেকেই উন্নত। নানামুখী চিকিৎসা রয়েছে ভারতে। বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেন। অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন রোগের চিকিৎসা এলোপ্যাথিতে যেমন আছে, তেমনি হোমিওপ্যাথিতেও আছে। যার যে চিকিৎসা ব্যবস্থা পছন্দ সে সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। সব পদ্ধতিতেই চিকিৎসা নিয়ে আসছেন মানুষ দীর্ঘকাল যাবত। অথচ তসলিমা নাসরিন কলমের খোঁচায় সেসব ওষুধ বাতিল করে দিয়ে সরকারকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে ওষুধ সরিয়ে নেয়া যায় ততই মঙ্গল। করোনাভাইরাসের চেয়ে সরকারের বাতলে দেয়া ওষুধগুলো অধিক বিপজ্জনক কি না! সে বিষয়ে বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞজনেরাই মত দেবেন বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : চিত্রশিল্পী ও শিল্পকলার অধ্যাপক