যে ক্ষতির মুখে পড়ল ভারত
যে ক্ষতির মুখে পড়ল ভারত - সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো গত সপ্তাহে ভারত সফর করেছেন। এই সফরের মধ্যে ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হোম স্টেট গুজরাটে একটি বিশাল সংবর্ধনা (যা সম্ভবত ট্রাম্প ভুলতে চাইবেন না) এবং প্রতিরক্ষা, টেলিকম, জ্বালানি ইত্যাদি খাতে কয়েকটি চুক্তি হয়েছে।
ট্রাম্পের সফরটিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মোদি। বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও কাশ্মির স্থবির করার মতো নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রত্যাঘাতের মুখে পড়েছেন মোদি। মোদির কাছে এটি ছিল ইমেজ পুনর্গঠনের সুযোগ। অধিকন্তু, বেকারত্বের নতুন মাত্রার বিরুদ্ধে লড়াই করা ও অর্থনীতির বিপুল চাহিদা পূরণ করার জন্য ভারতের বেপরোয়াভাবে বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন।
কিন্তু ট্রাম্পের সফরের সময় এসব লক্ষ্য অনেকাংশেই পূরণ হয়নি, কারণ বিশ্বের নজর ছিল অন্যত্র। দিল্লিতে ট্রাম্পের হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়, এমন স্থঅনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এর জের ধরে এখনো মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের নজর ওই দিকে ঘুরে গেছে। ১৯৮৪ সালে শিখ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর থেকে এটিই দিল্লির সবচেয়ে খারাপ দাঙ্গা। এমনকি ট্রাম্প পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে তিনি মোদির সাথে বৈঠকের সময় ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি উত্থাপন করা দরকার ছিল।
ভারতের জন্য দিল্লির দাঙ্গায় পররাষ্ট্রনীতিতে বিপুল মূল্য রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকের সময় মোদি ভারতের সফট পাওয়ারের (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে তিনি যে সমর্থন পেয়ে থাকেন) মাধ্যমে আনুকূল্য কামনা করেছিলেন। গত বছর হিউস্টোনে ‘হাউডি মোদি’ সমাবেশেও এই টার্গেট ছিল। আর গুজরাটে এক লাখ লোকের সমাবেশেও একই সুর ছিল।
সিএএ ও দাঙ্গার জের ধরে ওই সমর্থন অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। বেশ কিছু দিন থেকেই প্রবাসী ভারতীয়দের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলোর সামনে বিক্ষোভ করে আসছিল। তারা সিএএকে ভারতীয় মূল্যবোধের বিরোধী বলে মনে করছিল। নিউ ইয়র্কে ইশিতা শ্রীবাস্তব নামের এক বিক্ষোভকারী আল জাজিরাকে বলেন, আমি সেক্যুলার ভারতের আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছি। দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের সফট পাওয়ারের বেসরকারি রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা পালন করছিলেন অনেক ভারতীয় শিক্ষাবিদ। তারাও এখন অবস্থান পরিবর্তন করছেন।
তবে সমস্যাটি কেবল প্রবাসীদের মধ্যেই আর সীমিত নেই, এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের দুই রাজনৈতিক দল থেকেই সমর্থন পেয়ে আসছিল দিল্লি। সম্প্রতি ডেমোক্র্যাটরা সহিংসতার নিন্দায় যোগ দিয়েছে। ভারত সফরকালে দাঙ্গা দমনে ভূমিকা পালন করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের সমালোচনা করে প্রেসিডেন্ট মনোনয়নপ্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স টুইট করেছন যে এটি হলো মানবাধিকার প্রশ্নে নেতৃত্বের ব্যর্থতা।
অর্থনৈতিক খাতেও দাঙ্গার ফলে মোদির উদ্দেশের সাথে আপস করেছে। ভারতে যে সংবর্ধনা পেয়েছেন সেজন্য নয়া দিল্লির প্রতি ট্রাম্প কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও এই খুশিই ভারতে আমেরিকান বিনিয়োগ আনতে পারছে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ওইসব দেশে যায়, যেখানে আইনশৃঙ্খলার রেকর্ড ভালো ও স্থিতিশীল। দাঙ্গা নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কভারেজে উভয় ব্যাপারে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর আঘাত হেনেছে। দি আটলান্টিকের একটি তীব্র সমালোচনামূলক প্রতিবেদনে দিল্লির সহিংসতাকে ‘গণ-নির্যাতন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে এবং ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে এর পেছনে সরকারি ইন্ধন ছিল।
দাঙ্গার সময় দিল্লি পুলিশের আচরণ এ ধরনের মন্তব্য প্রকট করে তুলছে। প্রতিবেদনগুলোতে হয় পুলিশের অযোগ্যতা কিংবা তাদের নিন্দনীয় ভূমিকা প্রকাশ করা হয়েছে। একটি ভয়াবহ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একদল ভয়াবহভাবে আহত লোককে পিটিয়ে তাদের দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করা হয়, আর তা করা হয় দাঙ্গা সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে। আঘাতপ্রাপ্ত লোকদের একজন এরপর মারা যায়।
ভারতের রাজধানী নগরীর গুরুত্ব বিবেচনা করে দিল্লির পুলিশ বাহিনী রাখা হয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর হাতে। যেসব বিনিয়োগকারী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে দেখেছেন, তারা দেখতে পেয়েছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফরের সময় রাজধানী নগরীর আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। ভারতের আইনি ব্যবস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীরা আস্থা স্থাপন করতে পারবে না।
ট্রাম্পের সফরে যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছিল, দিল্লির দাঙ্গার ফলে তার বিপরীত ঘটনাটিই ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্ঘনে ভারতের চলমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাই প্রধান খবরে পরিণত হয়েছে। দাঙ্গার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যয় নিশ্চিতভাবেই দাঙ্গার চেয়ে অনেক বেশি হবে।
লেখক : পলিসি বিশ্লেষক এবং এডিটর-ইন-চিফ, ফ্রিডম গ্যাজেট
দি ডিপ্লোম্যাট