মার্কিন-তালিবান চুক্তি এবং ভারতের উদ্বেগ
মার্কিন-তালিবান চুক্তি এবং ভারতের উদ্বেগ - সংগৃহীত
আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি শনিবার দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালিবান একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর জের ধরে আমেরিকা ও ন্যাটো আগামী ১৪ মাসে সেনা সরিয়ে নেবে।
এই চুক্তি ছিল আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাত, যাকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না আমেরিকা ও তালিবান বলে যারা পরিচিত, তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। চার পৃষ্ঠার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন আফগানিস্তানে আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধি জালমি খলিলজাদ এবং তালিবানের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মোল্লা আবদুল গ়নি বারাদর।
এছাড়া পৃথকভাবে আফগান সরকার (আফগানিস্তানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কাবুলে যৌথ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে।
মূল বিষয়
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক মার্কিন বিদেশ প্রতিনিধি লরেল মিলার মার্কিন-তালিবান চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করেছেন।
সেনা প্রত্যাহার : আমেরিকা ১৩৫ দিনে ৮৬০০ সেনা সরাবে এবং ন্যাটো ও অন্যান্য কোয়ালিশনের সেনার সংখ্যাও আনুপাতিকভাবে একইসঙ্গে কমানো হবে। সমস্ত সেনা প্রত্যাহৃত হবে ১৪ মাসের মধ্যে। এসবের মধ্যে ধরা থাকবে অসামরিক, অকূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গও। (এর অর্থ গোয়েন্দাবিভাগের লোকজনও)।
তালিবানের প্রতিশ্রুতি : সন্ত্রাসবিরোধী যে মূল প্রতিশ্রুতি তালিবান দিয়েছে তা হলো, তালিবান তাদের কোনো সদস্য, কোনো ব্যক্তি বা আল কায়দাসহ কোনো সংগঠনকে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে আমেরিকা বা তাদের মিত্রশক্তির বিপদ তৈরি করতে দেবে না। মিলার বলছেন, এখানে আল কায়দার উল্লেখ অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তবে এই চুক্তিতে ভারত বিরোধী লসকর এ তৈয়বা বা জৈইশ এ মোহম্মদের উল্লেখ করা হয়নি। ভারত আমেরিকার মিত্রশক্তি না হওয়ায় তারা এই চুক্তির দ্বারা সুরক্ষিত নয়।
নিষেধাজ্ঞা অপসারণ : তালিবান নেতাদের উপর জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞা আগামী তিন মাসের মধ্যে (২৯ মে-র মধ্যে) এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ২৭ অগাস্টের মধ্যে প্রত্যাহৃত হবে। আফগানদের নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বিশদ অগ্রগতির আগেই এই নিষেধাজ্ঞা উঠতে চলেছে।
বন্দিমুক্তি : মিলার মার্কিন-তালিবান চুক্তির এই বিষয়টিকে সম্ভাব্য সমস্যার জায়গা বলে চিহ্নিত করছেন। যৌথ ঘোষণায় এ সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলা রয়েছে। আশরফ গ়নি নেতৃত্বাধীন সরকার তালিবানদের সামনে এত বড় সুযোগ করে দেবার বিষয়ে কতটা খুশি তা স্পষ্ট নয়। যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বাস নির্মাণের জন্য তালিবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চলবে, যার মধ্যে দু পক্ষেরই বড় সংখ্যায় বন্দি মুক্তির পদক্ষেপের বিষয়টিও। যৌথ ঘোষণায় এ ব্যাপারে কোনো সংখ্যা বা তারিখের কথা বলা নেই। মার্কিন-তালিবান চুক্তিতে বলা হয়েছে ১০ মার্চের মধ্যে ৫০০০ তালিবান বন্দিদের ছাড়া হবে এবং উল্টোদিক থেকে তালিবানও ওই সময়ের মধ্যে তাদের হাতে বন্দি ১০০০ জনকে ছাড়বে। ওই সময়ে অসলোতে আফগানদের মধ্যে আলোচনা শুরু হবার কথা।
যুদ্ধবিরতি : আরেকটি সম্ভাব্য সমস্যার জায়গা। চুক্তিতে বলা হয়েছে আফগানদের মধ্যে আলোচনা শুরু হলে তা একটি আলোচ্য বিষয়, এবং ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে প্রকৃত যুদ্ধবিরতি আসবে আফগান রাজনৈতিক চুক্তি সম্পন্ন হবার পরেই।
সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে
আমেরিকা যে আফগানিস্তান সরকারকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেনি তা বোঝাতেই এবারের যৌথ ঘোষণা। তালিবান যা চেয়েছিল, তাই পেয়েছে। সেনা প্রত্যাহার, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বন্দিমুক্তি। এর ফলে পাকিস্তানের হাতও শক্ত হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের প্রভাব বাড়তে চলেছে। এ কথা কোথাওই অস্পষ্ট রাখা হয়নি যে তারা ইসলামিক শাসন চায়।
আমেরিকা ও তালিবানের মধ্যে আলোচনার সময়ে আফগান সরকারকে একেবারেই পাত্তা দেয়া হয়নি। আফগানিস্তানের মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তা নির্ভর করছে তালিবান কতটা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তার উপরে এবং তারা ১৯৯৬-২০০১ সালে যে শাসন কায়েম করেছিল, সেখানে ফিরে যেতে চায় কিনা তার উপরেও।
আমেরিকা ও তালিবান তাদের প্রতিশ্রুতি কতটা রাখবে তার উপরে বিষয়টি নির্ভর করবে। প্রতিটি পদক্ষেপে আলোচনা চলবে। আফগ়ান সরকার কেমনভাবে বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত থাকছে তার উপরেও বিষয়টি নির্ভরশীল।
আফগানিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত জয়ন্ত প্রসাদের কথায় “শান্তির উদ্দেশ্যে এটি একদম প্রাথমিক পদক্ষেপ… বাইরের চাপ ছাড়া আফগানরা নিজেদের মধ্যে কীভাবে আলোচনা চালায় তার উপরেই নির্ভর করছে সেখানকার শান্তির বিষয়। ১৯৮৯, ১৯৯২, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পাকিস্তান গঠনমূলক ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল। সে সুযোগ তারা হারিয়েছে। প্রশ্ন হলো, এবার কি আলাদা কিছু হবে?”
ভারত ও তালিবান
নয়া দিল্লির জন্যও সামনে কঠিন দিন। খুবই প্রত্যাশিতভাবে যেসব দেশ শান্তি প্রক্রিয়ায় সাহায্য করেছে তাদের নাম বলতে গিয়ে মোল্লা বারাদর ভারতের কথা বলেননি, কিন্তু পাকিস্তানকে সমর্থন ও সহায়তা দেবার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
ভারত ও তালিবানের অতীত তিক্ত। নয়া দিল্লির তিক্ত স্মৃতিতে রয়েছে ১৯৯৯ সালের আইসি ৮১৪ হাইজ্যাক করার ঘটনা- যার জের ধরে মাওলানা মাসুদ আজহারকে মুক্তি দিতে হয়েছিল। মাসুদ আজহার পরে জৈইশ ই মোহম্মদ সংগঠন প্রস্তুত করে যারা ২০০১ সালে ভারতীয় সংসদ হানা, ২০১৬ সালে পাঠানকোট হানা ও ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হানায় যুক্ত বলে ভারতীয় মহল দাবি করে আসছে। তালিবান ভারতকে শত্রু দেশ বলে মনে করে কারণ ৯-এর দশকে ভারত তালিবান বিরোধী নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন জানিয়েছিল।
১৯৯৬-২০০১ পর্যায়ে তালিবান যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন ভারত তালিবানের সরকারি স্বীকৃতি দেয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, মার্কিন-তালিবান চুক্তি যখন গতি পাচ্ছে, সে সময়ে নয়া দিল্লি সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। কিন্তু পররাষ্ট্র নীতির কারণে তালিবানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়নি। এমনকি ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মস্কোয় পাঠানো হয় আফগানিস্তানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অমর সিনহা ও পাকিস্তানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত টিসিএ রাঘবনকে। তারা সেখানে বেসরকারি প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। তারা সরাসরি আলোচনায় অংশগ্রহণ করেননি, যদিও জানা গেছে বেসরকারি বেশ কিছু কথোপকথন হয়েছিল বলে জানা যায়।
নয়া দিল্লি ও কাবুল
ভারত গ়নি নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করে এসেছে, এবং গ়নির জয়ের পর যে কয়েকটি হাতে গোনা দেশ তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে ভারত তার অন্যতম। ভারতের সঙ্গে গ়নির সুসম্পর্কের অন্যতম কারণ পাকিস্তানের সীমান্ত সন্ত্রাস সম্পর্কে তাদের সমদৃষ্টিভঙ্গি। সরকারের তরফ থেকে গ়নি ও অন্যান্য বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে শুক্র ও শনিবার আলোচনা করবার জন্য পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে কাবুল পাঠানো হয়। অন্যদিকে মার্কিন-তালিবান চুক্তি বিনিময় অনুষ্ঠানে পাঠানো হয় দোহার রাষ্ট্রদূতকে।
স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ও সম্মেলক আফগানিস্তানের ব্যাপারে, যে আফগানিস্তান সমাজের সমস্ত বিভাগের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে, সে ব্যাপারে ভারতের যে দীর্ঘকালীন সমর্থন, তারই পুনরুল্লেখ করেছেন শ্রিংলা। আফগান নেতৃত্ব পরিচালিত, আফগানদের নিজস্ব ও আফগানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শক্তিকে ভারতের সমর্থনের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। তিনি নাম না করে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদকে দূরে রাখার আহ্বানও করেছেন।
ভারতের প্রতিশ্রুতির কথা বোঝানোর জন্যই এই সফর চলাকালীন বামিয়ান ও মাজার-এ-শরিফ প্রদেশের রাস্তা তৈরির কাজে ভারতীয় সহযোগিতার চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।
অনেক ভারতীয় কূটনীতিবিদই বলছেন শীর্ষ তালিবান নেতাদের সঙ্গে সরকারিভাবে যোগাযোগ না থাকলেও গোটা আফগানিস্তান জুড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের কমিউনিটি উন্নয়ন প্রকল্পের সূত্রে পাশতুনদের সঙ্গে ভারতীয় মিশনের ভালো রকম যোগাযোগ রয়েছে। এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রকল্পগুলোর কারণে, ভারতীয় কূটনৈতিকদের ধারণা ভারতের সম্পর্কে ভালো ধারণা রয়েছে আফগানদের মধ্যে, যাদের অধিকাংশই পাশতুন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ তালিবানের সঙ্গে যুক্তও হতে পারেন।
ফলে, কাবুলের ক্ষমতাচক্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী তালিবান মূল ভূমিকা পালন করলেও ভারতের পররাষ্ট্র দফতর বলছে, নয়া দিল্লির পক্ষে সবটা তত খারাপ নয়।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস