মুসলিমরা কেন ভয় পাচ্ছে?
মুসলিমরা কেন ভয় পাচ্ছে? - সংগৃহীত
স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এর জন্য ষষ্ট ইন্দ্রেয়ের প্রয়োজন হয় না। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ও এর পরের কয়েক দিনে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে শান্তি ভঙ্গকারী সহিংসতা (এতে ৪০ জনের বেশি নিহত হয়েছে) পুরোপুরি অনুমেয় ছিল। তবে একমাত্র দিল্লি পুলিশই মনে হয় অপ্রস্তুত ছিল। দি হিন্দুর ২৫ তারিখের খবর অনুযায়ী, প্রায় ১০০ পুলিশের উপস্থিতিতে সহিংসতা বিস্ফোরিত হয়। তারা দৃশ্যত পরিস্থিতিতে সাড়া দেয়নি।
কে প্রথমে উস্কানি দিয়েছিল, কিংবা কে প্রথমে পাথর নিক্ষেপ করেছিল কিংবা কে প্রথমে বন্দুর বের করেছিল, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সরকার ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের মধ্যকার লড়াইটি রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে এবং তা সিএএবিরোধী প্রতিবাদকারী ও সিএএপন্থী বিক্ষোভকারীদের মধ্যকার লড়াইয়ে পরিণত হয়।
২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বরের পর থেকে অনেক কিছু ঘটেছে। দিল্লির শাহিন বাগ ও আরো কয়েকটি নগরী ও শহরে অবস্থান ধর্মঘট, মিছিল, সমাবেশ হচ্ছে; নির্বাচনকালীন বাগাড়ম্বড়তা হচ্ছে; আদালতে অভিযোগ দাখিল হচ্ছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি এক বিজেপি নেতা দিল্লি পুলিশের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, দিল্লি পুলিশকে তিন দিনের আলটিমেটাম দিলাম, তাদেরকে এই সময়ের মধ্যে জাফরাবাদ ও চাঁদ বাগের রাস্তাগুলো পরিষ্কার করে দিতে হবে। এরপর আমাদের কাছে কোনো ব্যাখ্যা দেবেন না। আমরা আপনাদের কথা শুনব না। মাত্র তিন দিন।
কোনো পরিকল্পনা কি ছিল?
জওহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া (এখানকার ৪০ ভাগ ছাত্র অমুসলিম) ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত ছাত্রকে পুলিশের পিটিয়ে আহত করা নিয়ে নতুন নতুন প্রমাণ সামনে আসছে। দিল্লি পুলিশ ও উত্তর প্রদেশের পুলিশের (তারা কেবল উত্তর প্রদেশেই ২৩ জনকে হত্যা করেছে) নৃশংসতা নজরে আসছে। শত শত লোককে (প্রধানত ছাত্র) গ্রেফতার করা হয়েছে। দিন যতই গড়াচ্ছে, আদালত এফআইআর ও পুলিশ রিপোর্টের ব্যাপারে সত্য বের হয়ে আসছে। সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারপতি ভিন্নমত প্রকাশের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন এবং ভিন্নমতালম্বীদেরকে দেশবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
কিন্তু সরকার ভান করছে যে খারাপ কিছুই ঘটেনি। সরকারের কাছ থেকে যে একমাত্র বিবৃতিটি এসেছে, তাতে দৃঢ়তার সাথে সিএএ ও এনআরসির পক্ষে কথা বলা হয়েছে। এতে হুমকি ও প্রতিরক্ষার কথাই বেশি এসেছে।
ক্রমবর্ধমান হারে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে বিজেপি একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। অনেকে সন্দেহ করছেন যে বিজেপি চাচ্ছে যে ভিন্ন মতালম্বী লোকজন যেন তাদের অবস্থান আরো শক্ত করে রাজপথে নেমে আসে এবং এতে করে যেন মেরুকরণ সম্পূর্ণ হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো কঠিন ও সত্য নয়, কিন্তু বিক্ষোভকারীদের (কেবল মুসলিম নয়) সাথে সরকারের আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনে সন্দেহ গভীর হচ্ছে।
সিএএ-এনপিআর বাড়াচ্ছে ভয়
সরকার বলছে যে এনপিআর খারাপ কিছু নয় এবং সিএএ জাতীয় স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এ দুটি পরস্পরের সাথে সম্পর্কহীন। এই শিশুসুলভ যুক্তি কিভাবে কিছু লোক গলধঃকরণ করেছে, তা বোধগম্য নয়। এনআরপি কোনোভাবেই নিরীহ নয়। বেশ কিছু অশোভন প্রশ্ন যোগ করা হয়েছে ফর্মে। আর সিএএ স্পষ্টভাবেই বৈষম্যমূলক এবং তা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। অধিকন্তু, সিএএ ও এনপিআর পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। এনপিআর প্রথমে ‘স্বাভাবিক অধিবাসীদের’ শনাক্ত করবে এবং যাদের স্বাভাবিক অধিবাসী হিসেবে শনাক্ত করা যাবে না তাদেরকে ‘সন্দেহজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ‘সন্দেহভাজন’ কোনো লোক যদি হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ বা পারসি হয়, তবে তাকে নাগরিকত্বের জন্য সাধারণ আবেদনে রাখা হবে এবং তাদের নাগরিকত্ব মঞ্জুর করা হবে। বাকিরা হবে ‘সন্দেহভাজন’ তথা মুসলিম। তারা সিএএর আওতায় কোনো সুবিধা পাবে না।
আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এনপিআরের পর কোটি কোটি মুসলিম অসহায় অবস্থায় থাকবে। ফলে যে হাজার হাজার নারী ও শিশু, সাধারণত ঘরের ভেতরে থাকে, বৃষ্টি ও ঠাণ্ডা এবং পুলিশের লাঠি উপেক্ষা করে রাস্তায় বের হয়ে আসবে, তাতে কি আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে? তাদের মধ্যে আশা ও সাহস জুগিয়েছে হাজার হাজার অমুসলিম ও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন।
বেপরোয়া ও অগণতান্ত্রিক
বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েই দলান্ধ এজেন্ডা অনুসরণ করছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি অনিচ্ছুকভাবে ৬ মুসলিম প্রার্থীকে (তিনজন পশ্চিমবঙ্গে, দুজন জম্মু ও কাশ্মিরে ও একজন লক্ষাদ্বীপে। অন্যান্য রাজ্যে একজনও প্রার্থী ছিল না) মনোনয়ন দিয়েছিল। তারা এই তথ্যও গোপন করার কোনো চেষ্টা করেনি যে তারা মুসলিম ভোটারদের সমর্থন চায় না। দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গঠন করার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী একের পর এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যা মুসলিমদের ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। মুসলিমদের মধ্যে প্রায় সার্বজনীন ভয় ঢুকে গেছে যে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের স্বার্থ সুরক্ষা করবে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উপলব্ধি। উপলব্ধিই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
গণতান্ত্রিক ও যত্নশীল সরকার জনগণের কাছে যেত, আলোচনায় অংশ নিত। গত দুই মাসে এমন কিছুই ঘটেনি।
অপরিহার্য ফল পড়বে অর্থনীতিতে। গত কয়েক মাসে বিশ্বজুড়ে ভারতের সুনামে মারাত্মক আঘাত লেগেছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, মার্কিন কংগ্রেস কমিটি ও জাতিসঙ্ঘ সংস্থাগুলোতে তা দেখা গেছে। অনেক দেশ একান্তে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। উন্নত বিশ্বের আইনপ্রণেতা, বিনিয়োগকারী ও মতামত তৈরীকারীরা টাইম, ইকোনমিস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পড়ে এবং তাতে সমালোচনা প্রতিফলিত হয়।
ভারত অঘোষিত ধর্মরাষ্ট্রের মতো আচরণ করতে পারে। কিন্তু সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশের মতোও আচরণ করতে পারে। যে পন্থাই অবলম্বন করুক না কেন তা ভারতীয় জনগণ এবং বিশেষভাবে ভারতীয় অর্থনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী ও বিপুল প্রভাব সৃষ্টি করবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস