রক্তের গ্রুপের সাথে রোগের কি সম্পর্ক আছে?
রক্তের গ্রুপ - সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে রক্তরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রক্তের গ্রুপের সঙ্গে রোগের আদৌ কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? শরীরে ভুল রক্ত ঢুকলে তা কতটা মারাত্মক হতে পারে? এসব প্রশ্নের জবাব এখানে দেয়া হচ্ছে।
গোড়ার কথা
ব্লাড গ্রুপ কী, সে সম্পর্কে আমাদের সকলেরই একটা ধারণা রয়েছে। সবাই নিজের নিজের ব্লাড গ্রুপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা শরীরে রক্ত দেয়ার (ব্লাড ট্রান্সফিউশন) দরকার পড়লে ব্লাড গ্রুপ নির্ণয় করা ছাড়া গতি নেই। এক্ষেত্রে সামান্যতম গাফিলতিও চরম পরিণতি ডেকে আনতে পারে। কারো শরীরের ভুল রক্ত ঢুকলে তার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়তে পারে। কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। রক্ত জমাট বেঁধে অর্গ্যান ফেলিওর, স্ট্রোক এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির ফলে রক্তের মিসম্যাচ হওয়ার এই ঝুঁকি অনেকটাই কমে গেছে।
রক্ত কী?
রক্ত সম্পর্কে জানতে গেলে আগে তার প্রাথমিক উপাদানগুলো জানতে হবে। রক্তে উপস্থিত লোহিত রক্তকণিকার কাজ হল ফুসফুসের মধ্যে এবং ফুসফুস থেকে অক্সিজেন সংবহন করা। শ্বেত রক্তকণিকা আবার রক্তে মিশে যাওয়া ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ সঙ্গে লড়াই করে তাদের নিকেষ করে। প্লেটলেটের কাজ হলো রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা। সবশেষে আসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, প্লাজমা বা রক্তরস। এই উপাদানটি বাকিদের একজোট করে রাখে।
রক্তের গ্রুপ নির্ণয়
মানুষের রক্তের লোহিত কণিকার মধ্যে সাধারণত দুটি অ্যান্টিজেন পাওয়া যায় ‘এ’ ও ‘বি’। এই দুই অ্যান্টিজেন-এর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিই রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে। যা উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তান তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত মোট ৩৬টি ব্লাড গ্রুপ সিস্টেম এবং ৩৪০ রকম অ্যান্টিজেন খুঁজে পেয়েছেন বটে, কিন্তু সাধারণত চার ধরনের রক্তই মানবশরীরে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। সেগুলো হলো— এ, বি, এবি এবং ও। এ গ্রুপের রক্তে ‘এ’ অ্যান্টিজেন থাকে আর ‘বি’ গ্রুপের রক্তে ‘বি’। আবার ‘এবি’ গ্রুপের রক্তে দুটোই থাকে এবং ‘ও’ গ্রুপে ‘এ’ কিংবা ‘বি’ কোনও অ্যান্টিজেনই থাকে না। সারা বিশ্বে ‘ও’ গ্রুপের রক্তেরই আধিক্য রয়েছে। তারপরের স্থানে রয়েছে ‘এ’ অথবা ‘বি’ এবং সবশেষে ‘এবি’। আমরা সবাই রক্তের পজিটিভ ও নেগেটিভ দিকটা জানি। কিন্তু, তা কী করে নির্ণয় করা হয়, সেটাও জেনে রাখা ভালো। আমাদের রক্তে আরেক ধরনের প্রোটিন থাকে, যার নাম আরএইচ ফ্যাক্টর। এই প্রোটিন রক্তে থাকলে সেটা হয়ে যায় পজিটিভ। না থাকলে নেগেটিভ।
গবেষকরা দাবি করেছেন, বিশেষ বিশেষ গ্রুপের রক্তের সঙ্গে বিশেষ কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু, তাই বলে আপনি আপনার রক্তের গ্রুপ বদলে ফেলতে পারেন না। সেটা সম্ভবও নয়। তবে আগেভাগে কিছু সতর্কতা মেনে চললে সেই রোগগুলিকে প্রতিহত করা সম্ভব।
রক্ত ও রোগ
রক্তের গ্রুপের সঙ্গে রোগের প্রবণতা তৈরি হওয়ার একটা যোগসূত্র রয়েছে। দীর্ঘদিনের গবেষণা ও সমীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা সেটা দেখিয়েছেন। যেমন— ‘এ’ গ্রুপের রক্তে জমাট বাঁধার ক্ষমতা (কোয়াগুলেশন) বেশি থাকে। এই ধরনের রক্তের গ্রুপের অধিকারী ব্যক্তিদের মধ্যে থ্রম্বোএম্বোলিক ডিসঅর্ডারে (মাথায় বা ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া) আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এছাড়াও ‘এ’ গ্রুপের রক্তের মধ্যে পাকস্থলী বা অন্ত্রের ক্যান্সারের প্রবণতাও বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে, ‘ও’ গ্রুপের রক্তে এর ঠিক উল্টো বৈশিষ্ট্য থাকে। সেখানে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা এতটাই কম থাকে যে, একবার রক্তক্ষরণ শুরু হলে তা সহজে বন্ধ হয় না।
পাশাপাশি এবি গ্রুপের রক্তে স্মৃতিশক্তির সমস্যা, বি গ্রুপের রক্তে হৃদরোগের সমস্যা ইত্যাদির প্রবণতা বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। আমরা সাধারণত এ, বি, এবি এবং ও গ্রুপের রক্তকে প্রাধান্য দিলেও বাকি যে সমস্ত রক্তের গ্রুপ রয়েছে, তাদেরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন— ‘ডাফি’ ব্লাড গ্রুপ ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়ার জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে। আফ্রিকায়, যেখানে এই ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, সেখানকার অধিবাসীদের শরীরে কিন্তু এই গ্রুপের রক্ত একেবারেই পাওয়া যায় না। প্রকৃতিই তাদের এই ‘রক্ষাকবচ’ দিয়েছে।
অন্যদিকে, আরএইচ ব্লাড গ্রুপের ক্ষেত্রে মা যদি আরএইচ নেগেটিভ হন এবং তার সন্তান যদি পজিটিভ হয়, তাহলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। প্রথম সন্তান সুস্থ থাকলেও, গোল বাঁধে দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে। মায়ের রক্তের অ্যান্টিবডিগুলি শিশুর রক্তে থাকা লোহিত কণিকাগুলিকে ভেঙে দেয়। এই রোগকে বলা হয় এরিথ্রোব্লাস্টোসিস ফিটালিস। এছাড়াও রয়েছে ‘কেল’ ব্লাড গ্রুপ। এই গ্রুপের ক্ষেত্রে যদি মায়ের শরীরে কেল অ্যান্টিবডি থাকে এবং সন্তানের শরীরে যদি সেটার অ্যান্টিজেন থাকে তবে তা আরএইচ-এর থেকেও ভয়ঙ্কর। এতে শিশুটির শরীরে এরিথ্রোপোয়েসিস হয়, যা তার শরীরে রক্ত তৈরির ক্ষমতাকেই নষ্ট করে দেয়।
সূত্র : বর্তমান