বিরোধী দলের অপরিহার্যতা
খালেদা জিয়া : বর্তমানে কারাবন্দী - ছবি : সংগ্রহ
প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষই প্রত্যাশা করে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল কর্মপটু যোগ্য দক্ষ সরকারের। এমন আশা করাটাই স্বাভাবিক। কেননা, সব সচেতন নাগরিকই তার নিজের ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি কামনা করে। আর দক্ষ সরকারের পক্ষেই এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। দেশের উন্নতি হলে সর্বত্র শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। তাতে একটি মর্যাদাবান রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মানুষ যথার্থ মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারবে। সে কারণেই মানুষ যোগ্য সরকারের প্রত্যাশী হয়ে থাকে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের জন্য সবাই লালায়িত থাকে। সে জন্য দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের ক্ষমতায় অভিষিক্ত করার একমাত্র পথ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জনগণ কাক্সিক্ষত ব্যক্তিসমষ্টিকে বাছাই করতে পারে। এই পদ্ধতিটি সব গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। এমন অনুশীলনের ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া এই কারণে অত্যন্ত জরুরি যে, এর সাথে যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করার বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জড়িত। এ ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি হলে তাতে অযোগ্যরা ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়বে। আর অযোগ্যদের ভিড়ে যোগ্যদের হারিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। অযোগ্য অপদার্থদের জাতিকে দেয়ার মতো কিছু না থাকলেও তাদের পাওয়ার লোভ হয়ে থাকে সীমাহীন। এরা ক্ষমতা কোনোক্রমে কুক্ষিগত করতে পারলে কেবল তাদের এবং পার্শ¦চরদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ক্ষমতার জন্য এসব ব্যক্তি ‘অন্ধ’ বলে ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকতে তারা মরিয়া হয়ে থাকে। তারা এ জন্য নীতি নৈতিকতা ও বিধি-বিধানের কোনো তোয়াক্কা করে না। ফলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলণ্ঠিত হয় এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম হয়ে থাকে। সমাজে তারা সব প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়। মানুষের সব অধিকার শিকায় ওঠে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, স্বার্থান্বেষী একটি মহল এবং সাধারণ জনগণ সব ক্ষেত্রে সব ব্যাপারেই বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে।
গণতান্ত্রিক দেশের সরকার এবং কর্তৃত্ববাদিতা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি, সরকারের সাথে সমান্তরালভাবে বিরোধী দলের পথ চলার গুরুত্বও অপরিসীম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা সরকারকেও ছাপিয়ে যায়। সন্দেহ নেই, সরকারি দল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়ে থাকে। তেমনি এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সরকারের প্রতিপক্ষরাও দেশের বহু মানুষের সমর্থন পেয়েই বিরোধী দলের আসনে বসে। সে কারণে সংসদীয় ব্যবস্থা উভয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল রাখতে ভূমিকা রেখে থাকে। তবে মাত্রায় কম-বেশি তো থাকবেই। বিরোধী দল সরকারের প্রতিপক্ষ বা বিরোধী হিসেবে নয়, রাষ্ট্রীয় কর্মে তারা সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক সরকার নাগরিকদের অধিকার রক্ষা ও প্রাপ্তির বিষয়টি আঞ্জাম দিতে যতটা আন্তরিক ও তৎপর থাকে, ততটাই সতর্ক থাকে বিরোধী দল, যাতে জনগণ কোনোভাবেই তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। সে জন্যই তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হিসেবে পরিগণিত। সরকার যেমন জনগণের সম্মতি-সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করার দায়িত্ব পায়, বিরোধী দলও জনগণের একাংশের সমর্থন পেয়ে মানুষের অধিকারের পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষ করে ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান’ যুক্তরাজ্যে সরকারি ও বিরোধী দল এভাবে আখ্যায়িত হয়ে থাকে যে, ‘মহামান্য রানীর ট্রেজারি বেঞ্চ এবং রানীর অপজিশন’। এমন কি, ব্রিটেন যুক্তরাজ্যে বিরোধী দলের ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ থাকে। নীতি ও আদর্শ নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য ও তর্কবিতর্ক হয় বটে; কিন্তু সৌজন্যের সীমা কখনোই তাতে লঙ্ঘিত হয় না। এমন সহাবস্থান বজায় রেখে তারা দায়িত্ব পালন করে বলে যুক্তরাজ্য ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের মডেল’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত, সেখানে এই দেশটির শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করে প্রশাসন পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা কঠিন। কোনো ব্যাকরণ এগুলো অনুসরণ করে না। তাই এখানে নানা অব্যবস্থা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এসব বিষয়ে সর্বজনীন যে নীতি-পদ্ধতি স্বীকৃত রয়েছে, যেসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে যদি বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়, হতাশায় ভোগা ছাড়া উপায় নেই। মোটা দাগে ‘রাজনীতি’ বলতে যা সহজে বোধগম্য হয়, সেটা বোধহয় এই যে, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে এমন ভাবনা ও ক্রিয়াকর্ম যা অনুসরণ করলে জনগণের অধিকার, সর্বাধিক কল্যাণ ও অগ্রগতি সাধিত হবে। রাজনীতিমনস্ক মানুষ নিজেদের বোধ-বিবেচনার আলোকে এর সাথে সততাসহকারে সংযুক্ত হবে। এই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য মত ও পথের পার্থক্য থাকতে পারে। এই ভেদ সত্ত্বেও পরস্পর সহাবস্থান, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা প্রদর্শনের নীতি ও আদর্শে অটল-অবিচল থাকতে হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এ দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকরা এমন সরল রেখায় এখন চলছেন না।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে অনুশীলন তা নিয়ে স্বস্তি প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র তখনই দৃশ্যমান ও বিকশিত হতে পারে, যখন জনগণ নির্বিঘ্নে তার স্বাধীন মত প্রকাশ ও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। আর ভোটদান পদ্ধতি কতটা জনবান্ধব, স্বচ্ছ, প্রশ্নমুক্ত ভোট দেয়ার সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকা- এগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এসব নিয়ে এখন সাধারণ মানুষ, বোদ্ধা জনগোষ্ঠী ও সুশীল সমাজের যে অভিমত রয়েছে, তা বস্তুত গণতন্ত্রের দৈন্যকে তুলে ধরছে। বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে তার পরিচয় তুলে ধরতে চায় একটি ‘গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে। কিন্তু এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সমাজের যে মূল্যায়ন, সেখানে এমন স্বীকৃতি নেই। এখানে গণতন্ত্রের চর্চা এবং মূল্যবোধের উল্লেখ করার মতো কোনো মান বজায় থাকছে না। দেশের মানুষ গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে কতটা হতাশ এবং বিমুখ তার সর্বশেষ এক অকাট্য প্রমাণ দিয়েছে রাজধানীর শত লক্ষ ভোটার। এবার ঢাকা মহানগরীর দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা হচ্ছে- আনুমানিক ১২ থেকে ১৫ শতাংশ মাত্র। মহানগরীর দুই কোটি মানুষ ভোট নিয়ে এখন কতটা নির্লিপ্ত ও আশাহত, এই পরিসংখ্যান সেটাই পরিষ্কার করেছে। এর মাধ্যমে ঢাকাবাসী যে বার্তা দিয়ে গেছে, তার মর্ম বোঝার জন্য সরকার নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে ভাবতে হবে গভীরভাবে। নির্বাচনী পরিবেশ, জনগণের মাঝে আস্থা-বিশ্বাস সৃষ্টি এবং ভোটদানের পদ্ধতি নিয়ে তাদের ভাবনা ও পদক্ষেপ কতটা ত্রুটিপূর্ণ তা তাদের বুঝতে হবে। সেই সাথে আজ গণতন্ত্র যে মহাসঙ্কটে পড়েছে তা গভীর আন্তরিকতার সাথে উপলব্ধি করা দরকার। এই উপলব্ধির সঙ্কট থেকে জাতিকে উদ্ধারের জন্য নিষ্ঠা প্রমাণ দেয়া দরকার। নিছক লিপসার্ভিস দিয়ে আত্মতুষ্টি প্রকাশ করা হলে সেটি হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। গণতন্ত্র নিয়ে দেশ আজ যেখানে পৌঁছেছে, তাতে শুধু উদ্বেগ নয়, বাস্তব উদ্যোগ নেয়া অতি জরুরি বলে বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র ব্যর্থ হলে স্বৈরতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম হবে। অথচ এসবের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে।
ওপরে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সে আলোকে আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থায় কতটা যোগ্য ও সক্ষম, এ ক্ষেত্রে সরকার তার দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে পারছে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। একই সাথে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার গঠিত হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসে গেলে তা খুব অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার কথা নয়। ক্ষমতা নেয়ার আগে যদি চৌকস এবং সক্ষম ব্যক্তিদের বাছাই করার প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু হয়, তবেই যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠন করার ব্যাপারটি সহজ হবে। চৌকস ব্যক্তিদের সুষ্ঠু বাছাইয়ের পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন। এর কোনো বিকল্প নেই। যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হয়, সেখানে সঠিক বাছাইয়ের পর্বটি অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এই বাছাইয়ের পর্ব তথা নির্বাচন ব্যবস্থা শুদ্ধতার বিচারে কোনোভাবেই মানোত্তীর্ণ নয়। বেশ কিছুকাল যাবৎ যেসব নির্বাচন হচ্ছে, সেগুলো শত প্রশ্নে বিদ্ধ। এমন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের সঠিক পছন্দটি বেরিয়ে আসতে পারে না। এর পরিণতি হচ্ছে- দেশে চৌকস সরকার গঠন নিয়ে আশাবাদী হওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের এখন যে বাস্তব পরিস্থিতি, সেটা এ কথাই বলে যে, নানা অব্যবস্থা, অনিয়ম, দুর্নীতি আর দুরাচারীদের দৌরাত্ম্য জনগণের শান্তি-স্বস্তিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। তা ছাড়া নারী ও শিশুরা এখন প্রতিদিন যেভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা শিউরে ওঠার মতো। রাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক নাগরিক নারী। তাদের জীবনে যদি এভাবে নিরাপত্তাহীনতা নেমে আসে, তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালন এবং তাদের সক্ষমতার ওপর আস্থা রাখা যাবে কিভাবে? প্রশাসনের এসব দায়িত্বশীলকে নিয়ন্ত্রক হিসেবে সরকারের দক্ষতায়ও আঁচড় লাগাবেন। এ ছাড়াও রাষ্ট্রের জনকল্যাণের যতসব লক্ষ্য ও নির্দেশ রয়েছে, সেগুলোর এখনকার হাল-অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুললে হতাশা আরো বাড়বে। শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী একটি প্রজাতন্ত্র। সেই শাসনব্যবস্থা অধিকতর গণতান্ত্রিক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু সেই ধারণাকে বজায় রেখে চলার কোনো প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে না। সংসদীয় ব্যবস্থার মূল চেতনা হচ্ছে- সংসদ হবে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র আর জবাবদিহি করার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যে রাষ্ট্রে জবাবদিহিতার এমন দৈন্য, সেখানে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃত্ববাদী হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।
বিশ্বের যেকোনো পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় বিরোধী দলের গুরুত্ব এবং তাদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করার বিষয়। সরকার যে দায়িত্ব পালন করে থাকে, তাকে সঠিক পর্যায়ে রাখতে বিরোধী দলকে শ্রম-সাধনা করতে হয়। বিরোধী দল সতর্ক পাহারায় থেকে, সরকারের দায়িত্ব পালনে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি করে, তাকে চিহ্নিত এবং সেগুলোর প্রতিকার করবে। সেটা বাতলে দিতে বিরোধী দলকে অবশ্যই যথেষ্ট প্রজ্ঞা ও পটুতার পরিচয় দিতে হবে। সরকার ও তার প্রতিপক্ষের যৌথ প্রয়াসই প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রকে সফল করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশে বলতে গেলে, গত প্রায় ১০ বছর বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা নেই। এটা যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কত বড় ত্রুটি ও ক্ষতিকর তা আজ দেশের মানুষ উপলব্ধি করছে। বাংলাদেশে সংসদের প্রকৃত অর্থে কোনো বিরোধী দল নেই, তাই তাদের যোগ্যতা-দক্ষতা যাচাই করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তা ছাড়া যে নির্বাচনের মাধ্যমে তথা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে যারা পার্লামেন্টে এসেছেন, তাদের সে নির্বাচনের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, সেই সাথে জনগণের আছে ক্ষোভও। সেই নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন নির্বাচনের নামে এক প্রহসন। এমন নির্বাচনে যারা ‘বিজয়ী’ বলে নির্বাচন কমিশনের ছাড়পত্র পেয়েছেন, নীতি-নৈতিকতার বিচারে তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরিগণিত হওয়া কতটা যৌক্তিক, সে জিজ্ঞাসা রয়েছে ব্যাপকভাবে। এখন নিছক প্রথা-পদ্ধতির কারণেই তারা সংসদ সদস্য বিবেচিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে সরকার আর বিরোধী দলের সদস্য রয়েছেন। যারা নিজেদের বিরোধী দলের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করছেন, সেটা বিচার বিবেচনায় কতটা শুদ্ধ তাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা এই ‘বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের সহযোগী হিসেবে ভোট করেছে। দুই দল পরস্পর আপস-সমঝোতা করে ভোটে অংশ নিয়েছিল। জাতীয় পার্টি কোথাও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়ে লড়াই করেনি। নির্বাচনের পর আবার সমঝোতার ভিত্তিতেই জাতীয় পার্টি ‘বিরোধী’ দলের আসনে বসেছে। রাজনীতিতে এমন সব পাতানো বিষয়, বলতে গেলে অভূতপূর্ব।
জাতীয় পার্টির বিরোধী দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যে বৈধতার প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে সব ব্যতিরেকেই সংসদের এই দলের যে ভূমিকা ও কার্যক্রম, তাতে তাদের সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে সাব্যস্ত করে বিরোধী দলের এমপি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। বিরোধী দলের স্বাভাবিক ভূমিকা হলো, সরকারের ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক করে তা প্রকাশ করে তোলা; তা ছাড়া জনগণের সমস্যা এবং তাদের চাহিদা বঞ্চনাসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিবিধ বিষয় নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলা। এ সবের ধারে কাছেও জাতীয় পার্টি নেই। দল তো নয়ই, দলের এমন কোনো সদস্য নিজেকে বিজ্ঞ একজন পার্লামেন্টারিয়ান করে তুলতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে সংসদ হচ্ছে উচ্চতর বিতর্কের একটি জায়গা। সংসদের কথা বলার যে বিধি-বিধান, ব্যাকরণ ও শৈলীতা তা অনুশীলন করে এই মহান সভাকে প্রাণবন্ত করে তোলার ক্ষেত্রে বিরোধী দলই অবদান রাখতে পারে বেশি। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ যেন নিষ্প্রাণ জরাগ্রস্ত একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছে।
জাতীয় পার্টি নিজেই শুধু নিষ্প্রভ নয়, তাদের ব্যর্থতা গোটা জাতির জন্য অকল্যাণ বয়ে নিয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্র পরিচালনার সক্ষমতা ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়। অথচ সরকারের এসব দুর্বলতা নিয়ে বাইরে নয়, সংসদের ভেতরেই আলোচনা হওয়ার কথা। সরকারকে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সজাগ সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং তাদের নির্দিষ্ট বৃত্তে ধরে রাখার সাংবিধানিক দায়িত্ব বিরোধী দলের ওপর। তাই শুধু দক্ষ সরকার নয়, সেই সাথে একটি চৌকস বিরোধী দল অপরিহার্য, তা এখন ভীষণভাবে অনুভব করা হচ্ছে।
ndigantababor@gmail.com