দিল্লি দাঙ্গা : লাশটাও পাওয়া যাবে না!
কী হবে এসব মাসুম শিশুদের - সংগৃহীত
সাজিদ রহমানের শরীর কাঁপছে। একটু পরেই লাশ চিহ্নিত করার জন্য তাকে ডাকা হবে। জিটিবি হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে সাজিদ। তিন দিন ধরে এভাবেই প্রত্যেকবার তার শরীর কেঁপে ওঠে। দিল্লির একের পর এক হাসপাতালে যাচ্ছেন। মর্গে নিয়ে গিয়ে তাকে দেখানো হচ্ছে অজ্ঞাতপরিচয় লাশ। বলা হচ্ছে, এই কি তোমার ভাইপো? দেখে বলো! কান্না চেপে সাজিদ নতুন নতুন লাশ দেখছেন, জামা কাপড় চেনার চেষ্টা করছেন, ভাইপো মহসিনের হাতের বালা আছে কিনা দেখছেন। কিন্তু খোঁজ পাচ্ছেন না কিছুতেই। মহসিন নেই কোনো হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে। কোনো মর্গে। গত চার দিন ধরেই গভীর রাতে বাড়ি ফিরছেন সাজিদ রহমান। যাতে তবাসুমের মুখোমুখি হতে না হয়। কিছু প্রশ্ন করতে না পারে। ১৯ বছরের তবাসুম সাজিদের ভাইপো মহসিনের দু’মাসের বিয়ে হওয়া স্ত্রী। এবং এক মাসের গর্ভবতী।
সোমবার কারওয়াল নগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যমুনা বিহারে গিয়েছিল মহসিন। মহসিনের জেনারেটরের দোকান। ফেরার পথে দুপুর তিনটা নাগাদ শেষবার স্ত্রীকে ফোনে বলেছিল আসছি, এসে খাব। আসেনি আর। তবাসুমকে সাজিদ হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলছেন, এখানেও ডেডবডি নেই, তার মানে মারা যায়নি। কাঁদিস না। বেঁচে আছে মহসিন। জিটিবি হাসপাতালের মর্গের সামনে চোখে পানি নিয়ে সাজিদ বললেন, তবাসুমকে বলছি, কিন্তু জানি আর পাওয়া যাবে না। যে নারকীয় হত্যালীলা হয়েছে, পাওয়া যেতে পারে না। তাই বলে লাশটাও পাব না? তারপরই সাজিদ ঢুকলেন নতুন লাশ দেখতে। পাঁচ মিনিট পর বেরিয়ে শুধু মাথা নাড়লেন। গোটা শরীর ছাই। চেনা যায় না। মাটিতে বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সব হাসপাতাল তো শেষ! কোথায় সে? কাহা গয়ে রে মহসিন...!
দিল্লিতে মৃত্যু বেড়ে ৪২ হয়েছে। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিখোঁজের সংখ্যা। থানায় থানায় হেল্পলাইন খোলা হয়েছে নিখোঁজের তালিকা তৈরির জন্য। অসহায় মানুষ হাসপাতাল থেকে থানায় ছুটে বেড়াচ্ছেন হারানো স্বজনের খোঁজে। পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের এখনো দেখা গেল না উপদ্রুত এলাকায়। রাহুল গান্ধী বিদেশে। কংগ্রেসের শান্তিমিছিল আর আম আদমি পার্টির অবস্থান বিক্ষোভ সবই নিরাপদ রাজঘাটেই শেষ। অসহায় মানুষের ভরসা একে অন্যের প্রতিবেশিরাই। আছে শুধু শ্মশানে যাওয়া, আর কবরস্তানে হাঁটা।
ছবি আছে আপনার কাছে? শাবানার কাছে জানতে চাইলেন সাব ইন্সপেক্টর সুধীর রঞ্জন। জিটিবি হাসপাতালের মর্গের উল্টা দিকে নিখোঁজ তালিকা তৈরির তাঁবু তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ লাইন। শাবানা চিন্তা করছেন স্বামী ফিরোজ আহমেদের কোনো ছবি আছে কি না। পাশে থাকা দেওর বললেন, ঈদের ছবি ছিল না? কালো বাক্সে আছে মনে হয়! হাঁটছেন শাবানা। সফদরজঙ্গ হাসপাতাল, ট্রমা সেন্টার, এলএনজিপি সর্বত্র। ফিরোজকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের বিল্ডিংয়ে ঢুকে প্রতিটি ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে ভিতরে আগুনের বোতল ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল। তিনতলা থেকে দোপাট্টা দিয়ে নামিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীকে। তারপরই তিনি জানালা দিয়ে ঝাঁপ দেন। সেই শেষ দেখা। ফেরেনি ফিরোজ। শাবানা নাম লেখাচ্ছেন স্বামীর, গলি নম্বর সাত, কালিঘাটা...। স্যার, খুঁজে দিন। নয়তো আমাদের কী হবে বলুন! শাবানার হাহাকার মিশে গেল নিখোঁজ তালিকার রেজিস্টারে।
জামিমা বেগম বললেন, সবজি বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি জানেন। ছেলেটা কাছে থাকে না রোজ। চাচার বাড়িতে থাকে। দিনমজুরের কাজ করে। যেদিন কাজ পায় না সেদিন আমার কাছে আসে। ২২ বছরের মনিসের মা জামিমা বেগম। মনিস নিখোঁজ। জামিমা খুঁজছেন ছেলেকে। আমরা কোথায় যাব বলুন তো! লোনিতে গেলে বলছে কারওয়াল নগর যান। এলএনজিপি বলছে জিটিবিতে যাও। সন্ধ্যা হচ্ছে, জামিমা আর থাকতে পারবেন না। ফিরতে হবে। কেন? এত তাড়া কিসের? আবার কাল অন্য হাসপাতালে, অন্য কোনো মর্গে। দুই বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে এসেছি। যদি অসুস্থ হয়ে যায়? অসুস্থ হবে কেন? আলমারির মধ্যে বাচ্চাদের ঢুকিয়ে জামাকাপড়ের আড়ালে রেখে আসছি রোজ। ওখানেই খাবারও দিয়ে আসছি। যদি আবার হামলা করে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বুঝলাম, কতটা আতঙ্ক দিল্লিতে! হ্যাঁ, এতটাই!
সূত্র : বর্তমান