করোনায় বিশ্বে কী ক্ষতি হতে পারে
করোনায় বিশ্বে কী ক্ষতি হতে পারে - সংগৃহীত
উন্নয়ন ও পরিবেশ যে সমমুখী নয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত করোনাভাইরাসের প্রভাব। বিশ্বায়নের ফলে মানুষ যেমন মানুষের কাছাকাছি এসেছে তেমনি পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা রোগ-জীবাণু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজে ছড়িয়ে যাচ্ছে। লক্ষ করার বিষয় হলো, করোনার উৎপত্তিসংক্রান্ত যেসব তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসছে তার প্রত্যেকটি পরিবেশের সাথে কোনো-না-কোনোভাবে জড়িত। ধারণা করা হচ্ছে, একটি কাঁচাবাজারে বন্যপ্রাণী বিক্রয়ের পর থেকে বা একটি সি-ফুডের বাজার থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে। বন্যপ্রাণী ধ্বংস করা আর সামুদ্রিক পরিবেশ নষ্ট করা উভয়ই ইকোসিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর।
হুবেই প্রদেশের উহানকে চীনের দ্বিতীয় জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য এক মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, এ গবেষণাগার থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে থাকতে পারে। এক গণমাধ্যমে ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ড্যানি শোহমের সূত্র উল্লেখ করে জানানো হয় যে, উহানের এই ইনস্টিটিটিউট অব ভাইরোলজি চীনের প্যাথজেন লেভেল-৪ মানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবাণুপ্রযুক্তি গবেষণাগার। যেখানে জীবাণু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং চীনের এ ধরনের অবহেলা বিশ্বব্যাপী যে বিধ্বংসী অবস্থা সৃষ্টি করেছে তার দায়ভার চীনকেই নিতে হবে। এ ধরনের অসতর্কতাকে জৈবসন্ত্রাস নামে আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা, যার মাধ্যমে জীবাণু ছড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মার্কিন এক স্বাস্থ্য সাময়িকী জন হপকিন্স। ওই সাময়িকীতে গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায় বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, চীনে এমন একটি ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে যা অর্থনীতি টালমাটাল করে দেবে। পরিবেশের ক্ষতি সাধন থেকে শুরু করে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটাবে। বর্তমান পরিস্থিতি তাদের ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব রূপ দিয়েছে। এখন সন্দেহ দানা বেঁধেছে যে, তারা এত নিশ্চিতভাবে আশঙ্কা কেন করেছিল? কোনোভাবে এটা পূর্বপরিকল্পিত নয় তো? এ সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় কি? চীনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান যেখানে সব কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, খনিজসম্পদসহ অর্থনৈতিক বিপুল অংশের সমাহার সেই স্থান আক্রান্ত হওয়া মানে তো পুরো চীনই আক্রান্ত হওয়া। তবে বাংলাদেশ এ ধরনের জৈব সন্ত্রাসের বিরোধিতা করে ২০১৬ সালে ‘বায়োসেফটি, বায়োসিকিউরিটি, বায়োটেরোরিজম, বায়োডিফেন্স’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল।
কার্বন নিঃসরণ করে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করার প্রধান ভূমিকা চীনের। সাথে যুক্ত হলো জীবাণু সংক্রমণ। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলে বণ্যপ্রাণী পুড়ে যাওয়ার ঘটনা সর্বতোভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশকে করে তুলেছে মানবতাবিরোধী।
বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছে যে, ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাসের চেয়েও ক্ষতিকর করোনাভাইরাস। বাংলাদেশের একজন হাকিম সম্প্রতি করোনার প্রতিষেধক হিসেবে নিম তেলের ব্যবহারের কথা বলেছেন। তবে এটা কতটুকু কার্যকর তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট লিন্ফা ওয়াং বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এটি সাধারণত জেনেটিক ভাইরাস, যা প্রাণীর দেহ থেকে মানবদেহে সহজে চলে আসতে পারে। এটি ঠাণ্ডাজনিত রোগগুলোর একটি। যার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে জ্বর, ঠাণ্ডা, শুকনো কাশির কথা বলা হয়। আবার নিউমোনিয়া সদৃশ একটি রোগ হিসেবেও দেখা হয়। চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রও করোনাকে নিউমোনিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে রোগের নাম যা-ই হোক না কেন, এর প্রতিরোধের প্রস্তুতি কী সেটিই চিন্তার বিষয়।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের পাশাপাশি করোনা অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। যাতায়াত যোগাযোগের ওপর এর প্রভাব দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ওপরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। তা ছাড়া নতুন এলসি ও আগে এলসি করা পণ্যগুলো জাহাজীকরণ করা বন্ধ হয়ে গেছে অথচ চায়না-বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুক্ত রয়েছে। আমাদের তৈরী পোশাকের কাঁচামালের বেশির ভাগই আসে চীন থেকে। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও আমরা চীনের ওপর নির্ভরশীল হলেও তা সামলে নেয়া যাবে বলে বাণিজ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। অপর দিকে চীনের সাথে বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে ৯০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে, যার সাথে যুক্ত আছে দুই হাজারের বেশি চীনা বিশেষজ্ঞ। এরমধ্যে রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড হাইওয়ে ১৬ কোটি ডলার, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে ১৫ কোটি ডলার, কর্ণফুলী টানেলে ৭০ কোটি ডলার, আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ৩০ কোটি ডলার, পাওয়ার গ্রিডে ১৩২ কোটি ডলার, যার প্রতিটিই হুমকির মুখে বলে আশঙ্কা করেছে বিশ্লেষকরা। একই সাথে ভারতের অর্থনীতিকেও ছুঁয়ে গেছে করোনা। ‘বিক্রিতে ধাক্কা, নতুন আতঙ্ক করোনা’ শীর্ষক এক রিপোর্টে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ভাইরাস আতঙ্কে চীনের কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়েছে বিক্রিতেও। গাড়ি বিক্রি সংস্থাগুলোর সংগঠন ‘সিয়াম’ জানিয়েছে বিক্রি কমেছে ৬.২ শতাংশ।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, চলতি বছরের প্রথমে চীনের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ কমে যাবে। কেননা সমুদ্রতীরবর্তী প্রান্তিক এলাকাগুলোর পরই মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশ প্রধান অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা জিডিপিতে ৪ শতাংশ অবদান রাখে। একই সাথে এটি একটি ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে পরিচিত। এখানে গড়ে উঠেছে অটোমোবাইল নিসান, হোন্ডা ও জেনারেল মোটরসের কারখানা, যেগুলো বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নতুন বছরের শুরুর এই সময়টাতে চীন সারা বছরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি আয় করে এই খাত থেকে। গত বছর এ সময় চীনের অভ্যন্তরীণ আয় ছিল প্রায় এক ট্রিলিয়ন ইউয়ান। এ বছর তার পুরোটাতেই ধস নেমেছে। জাপানসহ প্রতিবেশী প্রত্যেকটি দেশে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বন্দরগুলোতে জাহাজ বা পণ্য বর্ধিতহারে আটকা পড়ছে। জাপানি পর্যটনশিল্প ৮০ শতাংশ চীনের ওপর নির্ভরশীল।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩ সালে চীনে সার্স ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল চার হাজার কোটি ডলারের। আর করোনায় বছরের শুরুতেই চীনের ক্ষতি ছয় হাজার কোটি ডলারের বেশি। এই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সামাল দেয়া চীনের জন্য একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।
লেখক : কলেজ শিক্ষক