প্যারোলে মুক্তি কি অসম্মানজনক?
খালেদা জিয়া - সংগৃহীত
দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কারাবন্দী থেকে মুক্তির বহুবিধ আলোচনা চললেও তার মুক্তির একমাত্র পথ হলোÑ সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা থাকা। দেশের জনপ্রিয় নেত্রী বেগম জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ইতোমধ্যে দুটি বছর কেটে গেছে। গণতন্ত্র উদ্ধারের আপসহীন জননন্দিত মহীয়সী এই নারী বন্দিদশায় দীর্ঘ দিনাতিপাত করা জনগণের কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। ক্ষমতাসীন সরকার এই সত্যটুকু অনুধাবন করতে দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষমতা থাকার লোভে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়ার মুক্তির ব্যাপক আলোচনা বিভিন্ন পর্যায়ে বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট এবং সরকারি মহলে চলছে। তবে এই নেত্রীর প্যারোলে মুক্তির আলোচনাটাই সরকারি মহলে জোরালোভাবে আসছে।
খালেদা জিয়ার পরিবার, তার দল, তার আইনজীবীর মাধ্যমে প্যারোলে মুক্তি চাওয়া কোনো প্রকার বেআইনি কাজ, নতি স্বীকার, কিংবা দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নয়। প্যারোল ইংরেজি শব্দ Pa-role যার অর্থ পালাতে চেষ্টা করবে না। অর্থাৎ বন্দী কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি, বন্দীর শর্তাধীন মুক্তি, পালাবেন না এই শর্তে বন্দীকে মুক্তি দেয়া। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দলের জনপ্রিয় এই নেত্রী যিনি ইতোমধ্যে দেশব্যাপী মাদার অব ডেমোক্র্যাসিতে ভূষিত হয়েছেন তিনি দেশে থাকুন অথবা দেশের বাইরে চিকিৎসাধীনে থাকুন, পালাবেন কেন? এর তো কোনো কারণ নেই। ফৌজদারি আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, কেউ স্বেচ্ছায় আদালতে হাজির হলে তার পালানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। Pa-role শব্দটির সঠিক অর্থ জানা না থাকায় যত সব আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সরকারি মহলেও তা নিয়ে অবিশ্বাস্য ধূম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে। মহামান্য উচ্চতর আদালতের নির্দেশে যেকোনো পর্যায়ে বন্দীকে চিকিৎসার জন্য বন্দী অথবা নিযুক্ত আইনজীবীর কাছ থেকে বন্ড রেখে তাকে মুক্তির নির্দেশ দিতে পারেন।
মন্ত্রীরা প্যারোল নিয়ে উদ্দেশ্যেমূলক বিবৃতি দিয়ে সরকারপ্রধানের নৈকট্য লাভের চেষ্টায় আছেন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, যিনি ৭৫ বছরের বৃদ্ধা এবং বিভিন্ন রোগাক্রান্ত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তার দীর্ঘ দুই বছর কারাবাস বিবেচনা করে সরকার সংবিধান অনুযায়ী সাজা মওকুফ করে মুক্তি দিতে পারেন। মানবিক কারণে মুক্তি দেয়া সরকারের জন্য রাজনৈতিক ফায়দা বয়ে আনবে। কিন্তু সরকার তার ব্যাপারে মানবতার দিক বিবেচনার বিপরীতে হাঁটছে। দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার প্রসঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ আলোকপাত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যে দুটি দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত- এ দুটি মামলাই ‘১/১১’ পর্যায়ে মইন-ফখরুদ্দীনের দুই বছরের অবৈধ শাসনের ফসল।
ওই দুটি মামলা বিএনপি চেয়ারপারসন জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়। তদ্রূপ অপর জনপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই জাতীয় দুর্নীতির মামলা দায়ের করে যথাক্রমে ১২টি ও ১৪টি মামলা সৃষ্টি করে অবৈধভাবে তাদের জেলে রেখে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ও নতুন দল সৃষ্টি করে দীর্ঘ মেয়াদি দেশ শাসনের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তদান্তীন ক্ষমতাসীনরা। তাদের এ স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এক বছর পর সরকার তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তারপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়ে নিজের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১৪টি মোকদ্দমাসহ তার দলের নেতাদের মোকদ্দমাগুলো উঠিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তার বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মামলাগুলো রেখে দিলেন। মইন-ফখরুদ্দীনের আমলের মোকদ্দমাগুলো ছিল শতভাগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বানোয়াট এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার রাজনৈতিক অপকৌশল। মইন-ফখরুদ্দীনের অবৈধ শাসনের বিদায়ের পর্যায়ে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো অনায়াসে বাতিল হওয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিন্তু ২০০৮ সালে নির্বাচিত সরকার রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বনে জননন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়ার মামলাগুলো চলমান রেখে দিয়ে দেশ থেকে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র নির্বাসন দেয়ার রাস্তা প্রশস্ত করেছে। মইন-ফখরুদ্দীনের সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত দুটি মামলার ব্যাপারে বলতে হয়, বেগম খালেদা জিয়া শতভাগ রাজনৈতিক কারণেই বন্দী আছেন। মামলায় সাজা দেখান, দুর্নীতির মামলা ইত্যাদি জনগণ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন রেখে জনপ্রিয়তা নস্যাৎ করার কৌশল মাত্র। খালেদা আপসহীন, তিনি জননন্দিত। গণতন্ত্রের ব্যাপারে, দেশের স্বার্থে তিনি আপস করবেন না, ক্ষমতাসীনরা দেশ থেকে গণতন্ত্রকে একরকম নির্বাসন দিয়েছেন। দুর্নীতির মামলা সাজা প্রদানের মাধ্যমে খালেদার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে সরকার তাকে মুক্ত করে দিতেন। ‘গণতন্ত্রের’ মা দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলেন, এটা জনগণ বিশ্বাস করে না; যার দরুন তার জনপ্রিয়তা আজো আকাশচুম্বী।
ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা পূরণের জন্য মইন-ফখরুদ্দীনের দায়েরকৃত মিথ্যা মোকদ্দমাগুলো সচল রাখা হয়। দীর্ঘ একযুগ পরে সরকার রাজনৈতিকভাবে মামলাগুলো সচল রেখে সাজা প্রদানের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে দেশ গণতন্ত্রহীন, ভোটের অধিকারহরণ এবং জনগণকে ভোটের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা দেশে উন্নয়নের ইতিহাস গড়ার কথা শতমুখে প্রচারের পাশাপাশি গুম, খুন, ক্রস ফায়ারের মাধ্যমে মানবাধিকারের লঙ্ঘন, সীমাহীন দুর্নীতি ও ঘুষ, ক্যাসিনো দুর্নীতি, লুটতরাজ, নারী নির্যাতন, যৌন অপরাধ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন অপকর্ম বৃদ্ধির অপশাসনকে আড়াল করে রেহাই পেতে চাচ্ছেন।
রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, খালেদা জিয়ার মুক্তির নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে দমন করে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা সৃষ্টি করে স্বৈরশাসনের ইতিহাস গড়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের লড়াই এবং স্বাধীনতার মূল্যবোধের পেছনে চালিকাশক্তি ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তখন ভোটের অধিকারের অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হলো। ইতিহাস পর্যালোচনায় এ টুকু বলা যায়, গণতন্ত্র, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়া থেকে জাতি বঞ্চিত হতে পারে না। স্বেচ্ছাচারিতায় যেতে যারা আছেন ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই তারা নিঃশেষ হতে বাধ্য। গণতন্ত্রের দেশে গণতন্ত্র পরাজয় মানে না, পরাজয় মানতে জানে না, আপসহীন বেগম খালেদা জিয়ার কৃতিত্ব এখানেই।
লেখক : ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারের সিনিয়র আইনজীবী