আটক কেন্দ্রেই শেষ হবে তাদের জীবন!
আটক কেন্দ্রেই শেষ হবে তাদের জীবন! - সংগৃহীত
হিমালয়ের কাছে একটি নদী উপত্যকায় পূরবী হাজং তার দুই সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতি দিন বিশাল, কাদামাটিতে তৈরী একটি নির্মাণস্থল অতিক্রম করতে হয়। এটি আসরে একটি আটক কেন্দ্র। নতুন নাগরিকত্ব নিয়ম পূরণ করতে না পারা লোকদের এখানে রাখা হবে। পূরবীর ভয়, শিগগিরই তাকেও এখানে থাকতে হতে পারে।
হাজং বলেন, আমার ভয় হচ্ছে যে কেউ একজন আমার বাড়ি এসে আমাকে এখানে ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দেবে। আসাম রাজ্যে তার গ্রামেই বানানো হয়েছে এই কেন্দ্রটি। তিনি বলেন, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, যাতে আমার এই ভাগ্য বরণ করতে না হয়। আমার পরিবার ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।
ওয়াচ টাওয়ারসহ উঁচু সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা এই কেন্দ্রে ‘বিদেশী’ ঘোষিত তিন হাজার লোককে রাখা হবে। এই রাজ্যটির নিয়ন্ত্রণ হাতে আছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন বিজেপির হাতে। দলটি অন্যান্য রাজ্যেও বিদেশী শনাক্ত করার কাজটি করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
এসব আটক কেন্দ্র আসলে ভারতজুড়ে চলমান বিশাল যুদ্ধের রণাঙ্গন। এই যুদ্ধে লাখ লাখ লোকের নাগরিকত্ব বাতিল করা হচ্ছে, দীর্ঘ দিনের জন্য ধর্মীয় উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। একটি ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক বিক্ষোভ মোদির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির কথাই প্রকাশ করছে। উল্লেখ্য, মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে যে অর্থনীতি সম্প্রসারণ বাদ দিয়ে তিনি হিন্দুত্ববাদের দিকে নজর দিচ্ছেন। আর ভারতের অর্থনীতি ২০০৯ সালের পর এখনই সবচেয়ে মন্থর অবস্থায় রয়েছে।
নতুন আটক কেন্দ্রটি আসামের বৃহত্তম নগরী গৌহাটি থেকে ১৩০ কিলোমিটার (৮০ মাইল) দূরে অবস্থিত। গৌহাটিতে এখন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে।
ক্যাম্পটি ২.৫ হেক্টর (৬ একর) এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এখানে নারী ও পুরুষ উভয় ধরনের বন্দীকেই রাখা হবে। এতে স্কুল ও হাসপাতালও থাকবে।
এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪৬৫ মিলিয়ন রুপি (৬.৫ মিলিয়ন ডলার)। চা উৎপাদনকারী রাজ্য আসাম হলো ভারতের অন্যতম গরিব রাজ্য। দেশের সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধির রাজ্যের একটি হলো আসাম।
আসামে যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে ১৯ লাখ লোক বাদ পড়েছে। আটক কেন্দ্রে রাখা তিন হাজার লোক হবে তাদের সামান্য একটি অংশমাত্র।
উঁচু প্রাচীর ঘেরা ক্যাম্পটিতে লোকজনকে গাদাগাদি করেই থাকতে হবে, তাছাড়া এখানকার ব্যবস্থাগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
গত বছর বিপুলভাবে পুনঃনির্বাচিত মোদির বিজেপি দীর্ঘ দিন ধরেই মনে করছে যে দেশের সেক্যুলার চরিত্র আসলে মুসলিমদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছে আত্মসমর্পণ। ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিমরা ১৪ ভাগ। কয়েক শ’ বছর আগে তাজ মহলের মতো আইকনিক স্থাপত্য নির্মাণকারী মুসলিম শাসকসহ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর চাপিয়ে দেয়া ভ্রান্তিগুলো সংশোধন করাকে দলটি তাদের এজেন্ডার মধ্যে স্থান দিয়েছে। দলটি মনে করে এই কৌশল গ্রহণ করায় তারা নির্বাচনে সুবিধা পাবে।
নাগরিকত্ব হলো ওই প্রয়াসের একটি বড় অংশ। মোদির ডান হাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় নথিহীন অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এখন পর্যন্ত আসাম হলো একমাত্র রাজ্য যেখানে নাগরিকত্ব দাবি যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই প্রক্রিয়াটি বিশৃঙ্ক্ষলার সৃষ্টি করেছে। আসামের নাগরিকত্ব তালিকায় কার্যত ১৯ লাখ লোককে রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে। তবে মূলত কারণিক ভুল ও পরিচিতি ভুলের কারণেই বেশির ভাগ লোক বাদ পড়েছে তালিকা থেকে। নথিপত্র না থাকা লোকজন হয়রানির শিকার হচ্ছে, তাদেরকে আরো খারাপ পরিস্থিতিতেও পড়তে হতে পারে।
ভারতে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সহজ নয়। লোকজনকে কয়েক প্রজন্মের পূর্বপুরুষদের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে উদ্বাস্তু নিবন্ধন সনদ, জন্ম সনদ, ভূমি ও প্রজাসত্ত্ব নথিপত্র, আদালতের কাগজপত্র।
বিজেপির জন্য এই প্রক্রিয়াটি কিছু অভাবিত সমস্যার সৃষ্টি করেছে। হিন্দুরাও নাগরিকত্ব আইন থেকে বাদ পড়েছে। পূরবী হাজং এদেরই একজন। এই সমস্যা লাঘব করার জন্য মোদির সরকার গত বছর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস করেছে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর অমুসলিমেরা নাগরিকত্ব পেতে পারে।
ভারতজুড়ে এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ হচ্ছে। আসামেও হচ্ছে। তবে হাজং মনে করেন না যে নতুন আইন তার কোনো উপকারে লাগবে। তিনি রাজ্য সরকার কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, তিনি এখানেই তার পুরো জীবন কাটিয়েছেন। তিনি বলতে পারেন না যে তার পূর্বপুরুষেরা প্রতিবেশী দেশ থেকে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, আমি ভারতীয়। আমি সব নথিপত্র দিয়েছি। কিভাবে আমার নাম বাদ পড়ল, তা বুঝতে পারছি না।
ভারতে জনসংখ্যার আদর্শ ৫ ভাগ ভ্রান্তি হার প্রয়োগ করে বলা যায়, এই প্রক্রিয়ায় মৌলিক ভুলের কারণে ভারতজুড়ে ৬৫ মিলিয়ন লোক রাষ্ট্রহীন হয়ে যাবে। অথচ ইতালির মোট জনসংখ্যাও এত নয়। আর এতে ব্যয় হবে ৭০০ বিলিয়ন ডলা, যা স্বাস্থ্য খাতে বার্ষিক বাজেটের সমপরিমাণ।
তবে নাগরিকদের রাষ্ট্রহীন করার পদ্ধতি হিসেবে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন কেবল ভারতেই করা হয়নি। মিয়ানমারেও করা হয়েছে।
আসামে নাগরিকত্ব দাবি প্রশ্নে আটক লোকজন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। কোরাঝার আটক কেন্দ্রে চার বছর কাটিয়ে দিয়ে মাস খানেক আগে আগের জীবনে ফিরতে পেরেছেন হালিমা খাতুন। এটি হলো বিদ্যমান ছয় কারাগারের একটি। আসাম পুলিশ যে ৯৭০ জনকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে ‘বিদেশী’ঘোষণা করেছিল, তিনি তাদের একজন। আটক লোকজনকে গাদাগাদি করে রাখা হতো। ৪০ জনের মতো লোককে রাখা হতো এক কক্ষে। তিনি বলেন, জনাকীর্ণ টয়লেট তাদের ব্যবহার করতে হতো। প্রাইভেসির বালাই ছিল না। তাদের খেতেও দেয়া হতো না ঠিক মতো।
৪৬ বছর বয়স্কা হালিমা খাতুন বলেন, পোল্টি ফার্মের মুরগির মতো থাকতে হয় সেখানে। এর চেয়ে মরাও ভালো।
আরো ১২৮ জনের সাথে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। তবে তার কষ্টের দিন শেষ হয়নি। তিনি ও তার চার সন্তান আসামের সর্বশেষ নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
তিনি বলেন, আমি জানি না ভাগ্যে কী আছে। আমাদেরকে ভয়ের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে।
তবে আসাম সরকার কারগারগুলোর অবস্থা খারাপ বলতে নারাজ।
তবে নাগরিকত্ব থেকে বাদ পড়া লোকদের শেষ পর্যন্ত কী হবে তা কেউই বলতে পারে না। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের ছয় মাস পরও যারা বাদ পড়েছে, তাদের কাছে নোটিশ পাঠানো হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকেও রাজ্য সরকারের কর্মকর্তারা কোনো নির্দেশনা পাচ্ছেন না।
মরিয়ম নেসার বাড়িও আসাম। ১০ বছর কারাভোগের পর তিনি এখন তার জীবন পুনর্গঠন করতে চাচ্ছেন। ক্যাম্পে থাকার সময় তিনি ছিলেন সাত মাসের অন্তসত্ত্বা। তার সন্তানটি মারা গেছে। আর তার মুক্তির দুই মাস আগে তার স্বামীও ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ও তার দুই ছেলেও নাগরিকত্ব তালিকায় স্থান পাননি।
মরিয়ম নেসা হলেন, কারাগারে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি, দোখজ মনে হয়েছে স্থানটি। তাকে যে অস্থায়ী কুঁড়েঘরে রাখা হয়েছিল, তাতে না ছিল বিদ্যুৎ, না ছিল পানি। তিনি বলেন, এখন আমি আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করে দিন কাটাই।
ব্লুমবার্গ