ভারতে কত লোক গরিব?
ভারতে কত লোক গরিব? - ছবি : সংগ্রহ
ভারত সফরের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন, এক দশকে ভারত তার দেশের ২৭০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যের বাইরে বের করে এনেছে। তিনি আরো বলেছেন, প্রতিদিন প্রতি মিনিটে ১২ জন ভারতীয় নাগরিক চরম দারিদ্র্যের বাইরে বেরিয়ে আসছে।
দারিদ্র্য কী, কিভাবে তা মাপা হয়?
কোনো ব্যক্তি বা একটি পরিবারের জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সম্পদের ঘাটতিকে দারিদ্র্য বলে উল্লেখ করা যায়। অর্থনীতিবিদ ও নীতিপ্রণেতারা ভোগ্যপণ্যের খরচ দারিদ্র্যরেখার নিচে থাকলে তাকে চূড়ান্ত দারিদ্র্য বলে মনে করেন। সরকারি ভাবে দারিদ্র্য রেখা হল, পভার্টি লাইন বাস্কেট (PLB)-এ উপস্থিত পণ্য কেনার খরচের জোগান। এই রেখার নিচে যারা বসবাস করেন তাদের দরিদ্র বলে উল্লেখ করা হয়। দারিদ্র্য রেখার কত নিচে গরিব মানুষ রয়েছেন, তা দিয়ে দারিদ্র্যের গভীরতা নিরূপণ করা হয়।
ভারতে দারিদ্র্যের মধ্যে কত মানুষ বাস করছেন, তার খতিয়ান নেবার জন্য এ যাবৎ ৬টি সরকারি কমিটি গঠিত হয়েছে। ১৯৬২ সালের কার্যকরী গোষ্ঠী, ১৯৭১ সালে ভিএন দাণ্ডেকর ও এন রথ কমিটি, ১৯৭৯ সালের ওয়াই কে আলাগ কমিটি, ১৯৯৩ সালের ডিটিলাকড়াওয়ালা কমিটি, ২০০৯ সালের সুরেশ তেণ্ডুলকর কমিটি এবং ২০১৪ সালের সি রঙ্গরাজন কমিটি। সরকার রঙ্গরাজন কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ না করায় এখনও পর্যন্ত তেন্ডুলকরের দারিদ্র্যসীমা অনুসারে দারিদ্র্যের নিরূপণ করা হয়। সে হিসেবে ভারতের ২১.৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন।
পভার্টি লাইন বাস্কেটে মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জীবনযাত্রার মানের জন্য দরকার পণ্য ও পরিষেবার কথা রয়েছে, যথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ভাড়া, যাতায়াত ও আমোদপ্রমোদ। খাদ্যের দাম ক্যালোরির হিসেব বা পুষ্টির লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে মাপা যেতে পারে। ১৯৯০ পর্যন্ত ক্যালোরির হিসেব চলত – ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ পাঁচজনের একটি পরিবারের জন্য কত ক্যালোরি প্রয়োজন তার যে নির্ধারিত পরিমাণ স্থির করে দিয়েছিল, হিসেব হত তার ভিত্তিতে। তবে এই পদ্ধতি সর্বজনমান্য না হওয়ায় টেন্ডুলকার কমিটি পুষ্টির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেয়।
লাকড়াওয়ালা কমিটির বক্তব্য ছিল স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সরকার প্রদান করবে- ফলে এই বিষয়ক খরচ প্রস্তাবিত বাস্কেট থেকে বাদ দেয়া হয়। যেহেতু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের খরচ ১৯৯০ থেকে ব্যাপক বাড়ে, সে কারণে তেণ্ডুলকর কমিটি সেগুলোকে বাস্কেটের অন্তর্ভুক্ত করে। বাস্কেটের এই সংস্কার ও অন্যান্য বদলের জেরে ১৯৯৩-৯৪ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা ৩৫.৯৭ শতাংশ তেকে বেড়ে ৪৫.৩ শতাংশে উপনীত হয়।
দারিদ্র্য নিয়ে সংখ্যা জরুরি কেন?
পিএলবি একটা বিতর্কিত বিষয়। ১৯৬২ সালের গোষ্ঠী বয়স ও লিঙ্গভিত্তিক ক্যালোরি প্রয়োজনীয়তার কথা ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। তেণ্ডুলকর কমিটির আগে পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের খরচ ধরা হয়নি – শহরাঞ্চলে মাত্র ৩২ টাকা ও গ্রামাঞ্চলে ২৭ টাকা মাথাপিছু দৈনন্দিন রোজগারকে দারিদ্র্যসীমা নির্দিষ্ট করার বিষয়টি ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল। রঙ্গরাজন কমিটি সমালোচিত হয়েছিল খাদ্যের বিষয়ে জোর দেবার জন্য- পুষ্টির উৎস হিসেবে খাদ্যে জোর দেবার কারণে শৌচ, স্বাস্থ্য, পরিষ্কার জলের প্রাপ্তি ও দূষণের বিষয়গুলি উপেক্ষা করা হয়েছিল।
দারিদ্র্যের সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কারণ অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা (যে প্রকল্পে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারকে ভরতুকিমূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়া হয়) ও রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা (যে প্রকল্পে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের স্বাস্থ্যবিমা দেওয়া হয়)য় নীতি আয়োগ বা পূর্বতন পরিকল্পনা কমিশনের স্থির করা দারিদ্র্যের সংজ্ঞা মেনে চলা হয়। কেন্দ্র এই প্রকল্পগুলির জন্য বরাদ্দ স্থির করা দরিদ্রের সংখ্যা অনুসারে। এখানে বাদ চলে গেলে পরিবারগুলি প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
দারিদ্র্য অন্য কীভাবে স্থির হয়?
২০১১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সাবিনা আলকায়ার এবং জেমস ফস্টার দারিদ্র্য নির্ধারণে দশটি মানক নির্ধারণ করেছিলেন। এগুলি হল পুষ্টি, শিশুমৃত্যু, স্কুলে কতবছর পড়াশোনা, স্কুলে উপস্থিতি, সম্পত্তির মালিকানা, যথাযথ বাড়ি, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, শৌচ ও পরিষ্কার রান্নার জ্বালানির প্রাপ্তি। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ থেকে বঞ্চিতরা দরিদ্র বলে গণ্য। ২০১৫-১৬-তে এই দশটি মানকের মধ্যে তিনটি বা তার বেশি থেকে বঞ্চিত ভারতবাসীর সংখ্যা ৩৬৯.৫৪৬ মিলিয়ন (৩৭ কোটির কাছাকাছি)।
২০১৫-১৬ সালে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য অনুপাত সব মিলিয়ে ছিল ২৭.৯ শতাংশ, গ্রামীণ এলাকায় ৩৬.৮ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে ৯.২ শতাংশ। রাজ্যওয়ারি হিসেবেও অনেকটা ফারাক দেখা গিয়েছিল, বিহারে দারিদ্র্য ছিল সবচেয়ে বেশি (৫২.৫ শতাংশ), তার পরেই ঝাড়খণ্ড (৪৬.৫ শতাংশ), মধ্য প্রদেশে ৪১.১ শতাংশ, উত্তর প্রদেশে ৪০.৮ শতাংশ। সবচেয়ে কম দারিদ্র্য ছিল কেরালায় (১.১ শতাংশ), দিল্লিতে ৪.২ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৬.১ শতাংশ, তামিল নাড়ুতে ৭.৩ শতাংশ এবং হিমাচলপ্রদেশে ৮.১ শতাংশ।
ভারতের বর্তমান দারিদ্র্যের মাত্রা কীরকম?
২০১৭-১৮ সালের ন্যাশনাল স্ট্যাটিসকাল অফিস পরিবারভিত্তিক গ্রাহক খরচের যে রিপোর্ট দেয়, তা ২০১৯ সালে উপেক্ষা করা হয়। ফলে ভারতের দারিদ্র্য সম্পর্কিত কোনও সাম্প্রতিক খতিয়ান নেই। অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যানড হিউম্যান জেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ যে সার্ভে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানে ২০১৫-১৬-র পরের খতিয়ান নেই।
সমাজবিজ্ঞানী এস সুব্রমনিয়ন একটি ফাঁস হওয়া নথির মাধ্যমে দেখিয়েছেন ২০১১-১২ তে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৩১.১৫ শতাংশ, ২০১৭-১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.১ শতাংশ। ওই একই সময়কালে ২৭০ মিলিয়ন থেকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২২.২২ মিলিয়নে। অর্থাৎ ৬ বছরে এ দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৫২ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫ কোটি ২০ লাখ।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস