ধরা খাচ্ছেন অনেক ভিআইপি ও রাজনৈতিক নেতা
পাপিয়া ও তার স্বামী -
যুবলীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে একাধিক রাজনীতিক ও ভিআইপির নাম প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়াও তার সাথে থাকা সুন্দরী তরুণী ও খদ্দেরদের নামও বলছেন। জাল টাকা উদ্ধার, মাদক, অস্ত্র, প্রতারণা আর যৌন ব্যবসার অভিযোগে গ্রেফতার এই নেত্রী মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যও দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
যুব মহিলা লীগের শীর্ষস্থানীয় দুই নেত্রী ও ঢাকার একজন সাবেক নারী এমপির আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকে মাদক ব্যবসায়, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি করতেন পাপিয়া। পাপিয়া শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক নয়, নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহরে। সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হওয়ার টার্গেট ছিল পাপিয়ার। আর এ কারণেই অনেক প্রভাবশালী নেতা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন পাপিয়ার কাছ থেকে। জানা গেছে, পাপিয়ার প্রতিষ্ঠিত অনলাইন-ভিত্তিক দেহব্যবসার প্রতিষ্ঠানটি এখনো সক্রিয়। অনলাইন-ভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকার বাইরে দেহব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন পাপিয়া।
এ দিকে পাপিয়াকে সুবিধা দেয়া গডফাদারদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। দুদক বলছে, পাপিয়া থেকে সুবিধা নেয়া রাজনৈতিক দলের নেতাদের তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তালিকা পাওয়ার পর তাদেরও নজরদারির আওতায় আনা হবে।
জিজ্ঞাসাবাদ সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে, রিমান্ডে পাপিয়া অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম ফাঁস করে দিয়েছেন। পাপিয়ার উত্থানের পেছনে কাদের ভূমিকা ছিল, কারা পাপিয়া গংদের কাছ থেকে নিয়মিত সুবিধা নিতেন, তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি গোপনে দেশত্যাগের সময় নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সেক্রেটারি শামিমা নূর পাপিয়াকে বিমানবন্দর এলাকা থেকে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতার অন্য তিনজন হলেনÑ পাপিয়ার স্বামী ও তার অবৈধ আয়ের হিসাবরক্ষক মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন, পাপিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবা ও সাব্বির খন্দকার। এ সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, দুই লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ জাল নোট, ৩১০ ভারতীয় রুপি, ৪২০ শ্রীলঙ্কান মুদ্রা, ১১ হাজার ৯১ মার্কিন ডলার ও সাতটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। এই নেত্রীর প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। তবে এর আড়ালে জাল মুদ্রা সরবরাহ, বিদেশে অর্থপাচার এবং অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পাপিয়া গ্রেফতার হওয়ার পরই বেরিয়ে আসতে শুরু করে তার অন্ধকার জগতের চাঞ্চল্যকর কাহিনী।
এরপর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট এবং ফার্মগেটের ২৮ নম্বর ইন্দিরা রোডের রওশনস ডমিনো রিলিভো নামের বিলাসবহুল ভবনে তাদের দু’টি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা, আগ্নেয়াস্ত্র, বিদেশী মদসহ অনেক অবৈধ সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।
র্যাবও পুলিশ সূত্র জানায়, পাপিয়ার উপার্জনের প্রায় সব সোর্সই অবৈধ। তার মূল উপার্জন ছিল ওপর তলার লোকদের মনোরঞ্জন করে অর্থ বা সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়া। আর এভাবেই গড়ে তোলে সে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিত্ত-বৈভব। মাসের বেশির ভাগ দিনই তার কাটত পাঁচ তারকা হোটেলে। মাসে কোটি টাকার ওপরে ভাড়া আসত সেসব হোটেল কক্ষের। এমনও দিন গেছে যেদিন পাপিয়ার মদের বিলই এসেছে দুই লাখ টাকার ওপরে। পরে দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি জাল টাকা উদ্ধার, অস্ত্র ও মাদকের পৃথক তিন মামলায় পাপিয়ার ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তার স্বামী মফিজুর রহমানেরও ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা করা হয়। এ ছাড়া মামলার অপর দুই আসামি পাপিয়ার সহযোগী সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবাকেও রিমান্ডে নেয়া হয়। জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা, অনৈতিক কাজ, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখার অভিযোগে পাপিয়া, তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে মতি সুমনসহ চারজনকে গত মঙ্গলবার থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে রাজধানীর বিমানবন্দর থানা পুলিশ।
রিমান্ডের প্রথম দিনেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন পাপিয়া। বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক ও পাপিয়ার বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কায়কোবাদ কাজী সাংবাদিকদের জানান, জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়ার অপরাধ জগৎ সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসছে। মূলত যুব মহিলা লীগের শীর্ষস্থানীয় দুই নেত্রী ও ঢাকার একজন সাবেক নারী সংসদ সদস্যের আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকে মাদক ব্যবসা, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি করতেন।
তিনি বলেন, এ ছাড়া চাকরি দেয়ার কথা বলে কিংবা বিদেশে পাঠানোর নামে অনেকের কাছ থেকে তিনি বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
কায়কোবাদ কাজী বলেন, নরসিংদীর এক ব্যক্তিকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে পাপিয়া তার কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা নেন। শেষ পর্যন্ত বিদেশে পাঠাতে না পারায় ওই ব্যক্তি টাকা ফেরত চাইলে তাকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। ওই ব্যক্তি থানায় মামলা করতে (গতকাল) এসেছিলেন। তাকে নরসিংদীতে মামলা করার পরামর্শ দেয়া হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম সাংবাদিকদের বলেন, আইনগত বাধা এড়াতে মামলাটির তদন্ত হাতে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদ করে পাপিয়ার কাছ থেকে আমরা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করছি।
তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, পাপিয়ার উত্থানের পেছনে কাদের ভূমিকা ছিল, কারা পাপিয়া গংদের কাছ থেকে নিয়মিত সুবিধা নিতেন, তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। আমরা প্রতিটি তথ্য গুরুত্বের সাথে নিচ্ছি এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক রিপোর্ট করছি। অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মনোরঞ্জনের জন্য পাপিয়ার নির্দিষ্ট কিছু তরুণী ছিল, যারা পাপিয়ার চাকরি করত। পাপিয়া তাদের মাসিক বেতন দিতেন। আনুষঙ্গিক খরচও তাদের দিতেন পাপিয়া। আর তারা মনোরঞ্জন করে যে টাকা কামাত তা সরাসরি পাপিয়ার অ্যাকাউন্টে জমা হতো। এর বাইরেও অনেক তরুণী পাপিয়ার নেটওয়ার্কে কাজ করত। যাদের মধ্যে বিদেশী তরুণীরাও ছিল।
একটি সূত্র বলেছে, পাপিয়া অনেক তরুণীরই সর্বনাশ করেছে। ভালো চাকরি বা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে অনেক তরুণীকে বাধ্য করেছে পতিতাবৃত্তিতে। সে ক্ষেত্রে তরুণীদের আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে পাপিয়া ও তার সহযোগীরা। অনৈতিক যৌনাচারের জন্য পাপিয়ার কাছে অনেকেই যেতেন। যাদের কাছে ওই তরুণীদের পাঠানো হতো। এই খদ্দেরদের মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছিল। ক্ষমতাবান, টাকাওয়ালাসহ অনেকেই নিয়মিত খদ্দের ছিলেন এই পাপিয়া নেটওয়ার্কের।