লাভ মোদি-ট্রাম্পের : ক্ষতি ভারতের
মোদি ও ট্রাম্প - সংগৃহীত
ভারতে ৩৬ ঘণ্টা অবস্থান ও মঙ্গলবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে আলাপ করার মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজের ও আমেরিকার জন্য বিপুল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লাভ করেছেন এবং মোদি তার নেতৃত্ব, তার মুসলিমবিরোধ ও ভারতের দমনমূলক রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রতি পূর্ণ অনুমোদন লাভ করেছেন।
কিন্তু দেশ হিসেবে ভারত অর্থনৈতিক পরিভাষায় কিছুই পায় নি। রাজনৈতিকভাবে দেশটির সম্ভাবনার অবনতি ঘটেছে। মোদিকে ট্রাম্পের সমর্থনের ফলে ভারত খুব সম্ভবত মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক সাম্প্রদায়িক প্রচারণা তীব্র করবে এবং পাকিস্তান ও চীনের ব্যাপারে বিভক্তি শানিত করবে।
ব্যয়বহুল অস্ত্র কিনে ভারত ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে এবং জ্বালানি সংগ্রহের বিকল্পগুলো সংকীর্ণ করে ফেলেছে। মার্কিন জেনারেল সিস্টেম অব প্রিফারেন্সের আওতায় কর সুবিধা (২০১৯ সালে প্রত্যাহার করা হয়েছে) ফিরে পাওয়া যায়ীন এবং ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের জন্য ওয়ার্ক ভিসা ইস্যু এখনো স্থগিত রয়েছে। খুচরা ব্যবসা ছাড়া ভারতে আমেরিকান বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়নি।
মোদির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প, এর মাধ্যমে ভারতে মোদির ম্রিয়মান হতে থাকা রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। ট্রাম্প আশা করছেন, মোদির (তিনি সাধারণভাবে ডানপন্থী ইন্দো-আমেরিকান সম্প্রদায়ের আইকন বিবেচিত হন) প্রশংসা করার মাধ্যমে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৪০ লাখ ইন্দো-আমেরিকানের সমর্থন পাবেন।
মোদিকে চিত্রিত করা হয়েছে ভারতীয়দের অনুসরণ করার জন্য উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী মডেল হিসেবে। মোদির ইউএসপি ফলাও করে তুলে ধরেছেন ট্রাম্প এই বলে যে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সামান্য চাওয়ালা থেকে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ট্রাম্প যখন মোদির আরেকটি বৈশিষ্ট্য তথা তাকে ভালো বন্ধু এবং একজন কঠোর আলোচক হিসেবে অভিহিত করেন, তখন মোদি উত্তেজিত হয়ে ট্রাম্পকে আলিঙ্গন করেন। ট্রাম্প এর মাধ্যমে মোদির দাবিকেই অনুমোদন করলেন। কারণ মোদি নিজেকে শক্তমানব দাবি করে বলে থাকেন যে তিনি ভারতের স্বার্থ কারো কাছে সমর্পণ করবেন না এবং তার হাতে ভারত নিরাপদ থাকবে।
মোদির প্রতি ট্রাম্পের প্রশংসা অবশ্যই বিজেপিতে তার অনুসারীদের কাণে সঙ্গীতের মতো বেজেছে। উল্লেখ্য, দখলটি রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে হারছে এবং নয়া দিল্লি ও আরো কয়েকটি নগরীতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে মুসলিম প্রত্যাঘাতের মুখে পড়ছে।
ট্রাম্পের সফর থেকে ভারতের উদযাপনের মতো তেমন কিছু না থাকলেও মোদি ও তার হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। ট্রাম্প বলেছিলেন যে তিনি মোদির সাথে একান্ত আলাপচারিতায় মুসলিম ইস্যু উত্থাপন করবেন, কিন্তু মনে হচ্ছে যে মোদির মুসলিমদের সাথে কঠিনভাবে কাজ করছেন বলে যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতেই সন্তুষ্ট হয়েছেন।
সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ নাগরিকত্ব আইন প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেছেন যে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। দিল্লিতে চলমান হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘাত সম্পর্কে ট্রাম্প বলেন, ভারত সরকার দা দমন করবে এবং তার বিচ্ছিন্ন ঘটনা হওয়ায় তা গুরুত্ব পাবে না।
প্রতিরক্ষা চুক্তি
মঙ্গলবার নয়া দিল্লিতে ভারতের সাথে ৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি চুক্তি চূড়ান্ত করার ফলে ট্রাম্প নির্বাচনের আগ দিয়ে তার আমেরিকান ভোটারদেরকে বলতে পারবেন যে তিনি এই বিক্রির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছেন।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ভারতীয় নৌবাহিনী ২৪টি এমএইচ-৬০আর সিহক হেলিকপ্টার পাবে। বিশ্বে এগুলোই সর্বাধুনিক সমুদ্র হেলিকপ্টার বিবেচিত হয়। লকহিড মার্কিটনের তৈরী এমএইচ-৬০আর সিহক হেলিকপ্টার ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তি বাড়াবে, আবার তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও লাভজনক হবে। কারণ চীনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় ভারতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চায় যুক্তরাষ্ট্র। এসব হেলিকপ্টার অত্যন্ত কার্যকর সোনার রিকনসান্সের মাধ্যমে সাবমেরিনে আঘাত হানতে পারে। এমএইচ ৬০ মাল্টি-রোল রোমিও কিরোর স্কাই পুরনো হয়ে যাওয়া ব্রিটিশের নির্মিত কিং হেলিকপ্টারের স্থলাভিষিক্ত হবে এবং দুই বছরের মধ্যে লকহিড মার্কিট এগুলো সরবরাহ করবে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ৮০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ছয়টি এএইচ-৬৪ই অ্যাপাচি হেলিকপ্টার পাবে। বোয়িং এএইচ-৬৪ অ্যাপাচি হলো টুইন-টার্বো শ্যাফট অ্যাটাক হেলিকপ্টার। এতে রাতে অভিযান চালানোর মতো ব্যবস্থা রয়েছে। ইতোমধ্যেই ভারতীয় বিমান বাহিনী এ ধরনের ২২টি হেলিকপ্টারের অর্ডার দিয়েছিল। এর সাথে এবার আরো ছয়টি হেলিকপ্টার যুক্ত হচ্ছে। রাশিয়ার পুরনো এমআই ২৫/৩৫ গানশিপের স্থলাভিষিক্ত হবে অ্যাপাচিগুলো।
অ্যাপাচি হেলিকপ্টার দেশেই তৈরী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটি মোদির মেক ইন ইন্ডিয়া প্রচারণাকে জোরদার করবে। বোয়িং ও টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমসের মধ্যে যৌথ উদ্যোগে এগুলো তৈরী করা হবে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব হেলিকপ্টারের খুচরা যন্ত্রাংশ ভারতীয় সরবরাহকারীরা দেবে। অবশ্য মোদির মেইক ইন ইন্ডিয়া কর্মসূচির এখন পর্যন্ত যে অবস্থা এবং ভঅরতের শিল্পায়নের মন্থর গতির কারণে ভারতে হেলিকপ্টার নির্মাণের পরিকল্পনা অবাস্তব বিষয়।
মোদির সাথে ভারতীয়দের জন্য ওয়ার্ক ভিসা ইস্যু নিয়ে কথা না বলে ট্রাম্প আমেরিকায় আমেরিকান নাগরিকদের জন্য চাকরির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইরান ও ভেনেজুয়েলার বদলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল ও গ্যাস কেনার জন্য ভারতের সাথে চুক্তির ফলে বর্তমানে মন্থর হয়ে পড়া মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সহায়তা করবে।
পররাষ্ট্রনীতি
হেলিকপ্টার বিক্রির মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরে চীনকে নিযন্ত্রণে রাখার কাজে ভারতকে কাছে পেয়েছেন ট্রাম্প। এসব সর্বাধুনিক হেলিকপ্টার চীনা রণতরী ও সাবমেরিনগুলোকে খুঁজে পেতে মহাসাগর চষে ফেলবে। এসব হেলিকপ্টার পেয়ে নয়া দিল্লি কোয়াড্রিলেটারাল (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া) জোট নিয়ে তার আপত্তি ঝেড়ে ফেলবে বলে আশা করছেন ট্রাম্প। চীনকে ক্ষুব্ধ করার শঙ্কায় কোয়াডে যোগ দিতে আগ্রহী নয় ভারত।
পাকিস্তান ফ্যাক্টর
ভারত আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ থেকে বিরত রাখতে পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছিল। এ ব্যাপারে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি প্রদান এড়িয়ে যান ট্রাম্প। তিনি বলেন যে পাকিস্তানি মাটি যাতে সন্ত্রাসীদের প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত না হয় তা নিশ্চিত করতে তিনি পাকিস্তানি নেতা ইমরান খানের সাথে তার সুসম্পর্ককে কাজে লাগাবেন।
পাকিস্তানের ব্যাপারে সতর্কভাবে প্রণীত নীতি অনুসরণ করেন ট্রাম্প। আফগানিস্তানের তালেবানের সাথে টেকসই শান্তিচুক্তি চূড়ান্ত করা ও আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই সেখান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা তার জন্য খুবই প্রয়োজন। তিন বলেন, যে পাকিস্তানের সাথে তার সম্পর্ক ভালো হচ্ছে। এর মানে হলো এই যে আফগানিস্তানে শান্তি ফিরে না আসা ও মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের আগে পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের ওপর তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করবেন না।
মোদির মেইক ইন ইন্ডিয়া পরিকল্পনার প্রতি মার্কিন বিনিয়োগ নিয়ে কথা না বললেও ট্রাম্প কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করে সেখানে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি ও চাকরি সৃষ্টির জন্য ভারতীয় উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। টাটা ও মহিন্দ্রা যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করেছে এবং তারা মার্কিন দূতাবাসে আয়োজিত সভায় ট্রাম্পকে বলেছে যে তারা তার সংস্কারে খুশি। ট্রাম্প বলেছেন যে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য তিনি নিয়মকানুনে আরো শিথিলতা আনবে।
এসব চুক্তির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে মার্কিন অস্ত্রের দাম পরিশোধ করার জন্য ভারতকে তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদ ব্যয় করতে হবে, আমেরিকান তেল ও গ্যাস কিনতে বাধ্য হবে, অথচ এগুলো আরো অনুকূল শর্তে ইরান ও ভেনেজুয়েলার কাছ থেকে কেনা সম্ভব ছিল।
সর্বোপরি এই সফর থেকে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, ট্রাম্প রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছেন। আর ভারত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই লোকসানে পড়েছে।
মোদি সরকার এখন তার বিভেদমূলক ও বিধ্বংসী সাম্প্রদায়িক নীতি এমনকি আরো তীব্রভাবে প্রয়োগ করতে সাহসী হবে। ভয়াবহ মার্কিন অস্ত্র পেয়ে নয়া দিল্লি তার পেশী শক্তি দিয়ে প্রদর্শন করলে পাকিস্তান ও চীনের সাথে তার সম্পর্কে আরো অবনতি ঘটবে।