হামিদ মীরের কলাম : আখেরি পয়গাম
হামিদ মীর - ছবি : সংগ্রহ
সাতসকালে ফোনে এক অজ্ঞাত নম্বর থেকে অনবরত কল আসছিল। সে দিকে খেয়াল না করে সংবাদপত্র পাঠে মগ্ন থাকলাম। এরপর হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে একটি মেসেজ দৃশ্যমান হলো- ‘আমি জাফর নায়েক’। এটা আমার জন্য ‘ব্রেকিং নিউজ’ ছিল, কেননা খাজা জাফর নায়েকের সাথে কিছু দিন ধরে যোগাযোগ হচ্ছিল না। তার পুরনো নম্বর বন্ধ ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ কল ব্যাক করলাম। খাজা সাহেব প্রথম রিংয়েই ফোন রিসিভ করে বললেন, তুমি কেটে দাও। আমি কল করছি। কাতারের নম্বরে তোমার ফোনে বেশি বিল কাটবে। অসন্তোষ নিয়ে বললাম, ‘খাজা সাহেব, এ কী বলছেন?
আগে বলুন, আপনার পুরনো নম্বর বন্ধ কেন?’ খাজা সাহেব বেশ দুর্বল ও অসুস্থ কণ্ঠে বললেন, “তিন-চার মাস বেশ কষ্ট ও পেরেশানিতে কাটল। ওই যে তুমি একটি কলামে (‘ফোঁপানো কান্না’ শিরোনামে কলামটি ৮ সেপ্টেম্বর-২০১৯ নয়া দিগন্তে প্রকাশিত) যে এতিমখানার কথা উল্লেখ করেছিলে, শ্রীনগরে ক্রমাগত কারফিউ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে ওটা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেছি, যেন এই ছোট্ট আশ্রয়কেন্দ্রটি কিছু নিষ্পাপ এতিমের জন্য মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাক। কিন্তু ওই এতিমখানা পরিচালনাকারী তত্ত্বাবধায়ক গ্রেফতার হয়েছেন। কেননা তিনি কারফিউতে শিশুদের জন্য ফলমূল, তরিতরকারির সন্ধানে বের হয়েছিলেন। এরপর পুলিশ ওই শিশুদেরকেও তুলে নিয়ে গেছে। আমি জানতে পারার পর অসুস্থ হয়ে পড়ি।”
খাজা সাহেব ব্যথাভরা কণ্ঠে বললেন, ‘আমার পনেরোটি শিশু নিখোঁজ হয়ে যায়। নিজ শহর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অস্থির হয়ে বসে থাকলাম। এই অস্থিরতার মধ্যে ফোনে শ্রীনগরে কিছু পরিচিত সরকারি লোকের কাছে সাহায্য চাইলে আমার আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও অভিযান শুরু হয়। আমি দুবাই থেকে দোহা চলে এলাম। নম্বর বদলে গেল। এরপর আরো অসুস্থ হয়ে পড়ি। এ সময় তোমার সাথে একবার যোগাযোগ হয়েছে, কিন্তু ওই নম্বরটা আমার ছেলের কাছে রয়েছে। নতুন নম্বর তোমাকে পাঠাতে পারিনি।’ খাজা সাহেব বেশ কষ্টে কথাগুলো উচ্চারণ করছিলেন।
বললেন, “শরীরটা বেশ খারাপ। ছেলেটা আমাকে তার ল্যাপটপে কিছু পাকিস্তানি সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ পড়তে দেয়। কিছুক্ষণ আগে তোমার কলাম ‘বিদ্রোহের মোহর’ পড়ে অন্তরে ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। বেশ কষ্ট পেলাম, বৃষ্টি ও ঠাণ্ডায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী যুবকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে।” খাজা সাহেবকে বললাম, ‘আপনি নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখবেন।’ এ কথা বলতেই খাজা সাহেব কিছুটা তিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘বন্ধু, আমরা কাশ্মিরিদের একটা সমস্যা হলো, আমরা মৃত্যুশয্যাতেও নিজেদের নয়, পাকিস্তানের জন্য চিন্তা করি।’ তিনি আরো বললেন, ‘একটি কথা বলব? যখন কাশ্মির তার গোলামির জিঞ্জির ভেঙে পাকিস্তানের অংশে পরিণত হবে, তখন কি আমরা গুম হওয়া মানুষের জন্য সোচ্চার হওয়া এবং জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অনুমতি পাবো, নাকি পাবো না?’ আমার কাছে এর কোনো উত্তর ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ কথার অর্থ কী?’ খাজা সাহেব বললেন, ‘আমরা বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের সবচেয়ে জালিম বাহিনীর জুলুম সহ্য করে আসছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যদি আমরা পাকিস্তানে যুক্ত হয়ে যাই, আর তোমাদের বিরুদ্ধে কখনো বিদ্রোহের মামলা দেয়া হয়, তাহলে কমপক্ষে কাশ্মিরিরা তো প্রতিবাদ করবে। তাহলে কি তাদেরও বিদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হবে?’ আমি বললাম, ‘খাজা সাহেব, নিজের বিদ্রোহী চিন্তার ডানাকে নিয়ন্ত্রণ করুন। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখানে কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আমরা যা বলার তা বলে ফেলি।’
খাজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে যুবকদের বিদ্রোহের অভিযোগে ইসলামাবাদ প্রেস ক্লাবের বাইরে থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের জামিনের আবেদনের ওপর আদালত কবে শুনানি করবেন?’ আমি বললাম, ‘ইসলামাবাদ হাইকোর্টে আজই শুনানি হবে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই যুবকদের কি জামিন হবে?’ জবাবে চুপ থাকলাম। খাজা সাহেব প্রশ্নটি আবার করলেন। ‘ওই যুবকদের জামিন হবে, না কি হবে না?’ আমি জবাবে বললাম, ‘খাজা সাহেব, পাকিস্তানের আদালতে বেশ ধাক্কা খেয়েছি। ধোঁকাও খেয়েছি অনেক। এখন কিছুই বলতে পারব না।’
তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘তাহলে তুমি তোমার কলামের শেষে এটা কেন লিখলে, বিদ্রোহের মিথ্যা মামলা বানানোর ধারা আদালতকে বন্ধ করতে হবে। পার্লামেন্ট এ কাজ করতে পারবে না।’ ব্যাখ্যা করে বললাম, ‘আদালত অন্য দফতরের তুলনায় আইন সম্বন্ধে বেশি জানেন ও বোঝেন। অবগত আছেন মিথ্যার ধ্বংসাত্মক পরিণাম সম্বন্ধেও। এ কারণে আমি লিখেছি, এ কাজ আদালতকেই করতে হবে।’ খাজা সাহেব কিছুটা উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘তাহলে শুনে নাও, আজ ওই যুবকরা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবে। মন বলছে, এ জুলুম শেষ হতে চলেছে। দয়া করে আদালত যে ফায়সালা করবেন, তা আমাকে অবশ্যই জানাবে।’ আমি ওয়াদা করলাম, আপনাকে আদালতের সিদ্ধান্তগুলো অবশ্যই জানাব। তিনি বললেন, ‘এখন আমাকে ওষুধ খেতে হবে। আমার পনেরো জন নিখোঁজ এতিম শিশু ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া করবে।’ তিনি ফোন বন্ধ করে দিলে আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। পৌনে ৯টা। তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে রওনা দিলাম। সেখানে পৌঁছলাম ১০টার সময়।
২২ জন বন্দী যুবকের শুভাকাঙ্ক্ষী ও উকিলে আদালত গিজগিজ করছিল। শুনানি শুরু হলে চিফ জাস্টিস আতহার মিনাল্লাহ জানতে চাইলেন, আইজি সাহেব কোথায়? তাকে জানানো হলো, আইজি সাহেব ছুটিতে আছেন। তিনি বললেন, ডিসি কোথায়? ডিসি সাহেব সামনে এলেন। চিফ জাস্টিস বললেন, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী শিক্ষিত যুবকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মামলা কিভাবে আপনারা তৈরি করলেন? ডিসি বললেন, স্যার, আমি ওই দিন ছুটিতে ছিলাম। আমরা মামলা থেকে বিদ্রোহের বিষয়টি বাদ দিয়ে দিয়েছি। চিফ জাস্টিস জিজ্ঞেস করলেন, এই শিক্ষিত যুবকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের ধারা কে ঠিক করে দিয়েছেন? জবাবে নীরবতা বিরাজ করল। চিফ জাস্টিস বললেন, যে লোকেরা হাজার হাজার পাকিস্তানিকে হত্যা করেছে, আপনারা তাদের সাথে সংলাপ করেন। আর বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে আসা ব্যক্তিদের জোরপূর্বক ‘সন্ত্রাসী’ বানিয়ে দিচ্ছেন। এ ধরনের মামলায় পাকিস্তানের নামে বদনাম হবে।
আপনারা এমনটি কেন করেছেন? পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে এর কোনো জবাব ছিল না। জানি না কোন বেকুব আম্মার রশিদ ও নওফেল সালিমির বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করিয়েছিল। আদালত ওই যুবকদের ব্যক্তি জামানতের ভিত্তিতে মুক্তি দিতে আদেশ দিলে বেশির ভাগ নারী-পুরুষের চোখ ছলছল করে ওঠে। মোশাররফ জায়দিকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছেন কেন?
তিনি বললেন, ‘পাঁচ দিন পর্যন্ত নিরপরাধ যুবকদের জেলে রাখা হয়েছে। কাঁদব না তো কী করব?’ আমার খাজা জাফর নায়েকের কথা মনে পড়ল, যা তিনি কিছুক্ষণ আগে বলেছিলেন- আজ ওই যুবকরা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবে। আমি তার নম্বরে রিং দিলাম। কোনো জবাব পেলাম না। কয়েক ঘণ্টা পর আবার রিং করলাম। জবাব পেলাম না। পরের দিন তার নম্বর থেকে কল এলো। তার পুত্র জানালেন, কাল খাজা জাফর নায়েকের শরীর খারাপ হলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি ইন্তেকাল করেছেন। পাকিস্তানের জন্য কল্যাণচিন্তা ও পাকিস্তানিদের ব্যথা অনুভবকারী ব্যক্তি এ ধরা থেকে চলে গেছেন। তার শেষ বার্তা ছিল, পাকিস্তানের যুবকদের সাথে এমন আচরণ করো না, যার দ্বারা দেশের বদনাম হয়।
পাকিস্তানের দৈনিক জং ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সংখ্যা থেকে
ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট, জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)