মুলতানি মাটি দিয়ে তাজমহলের ‘ফেশিয়াল’!
তাজমহল - সংগৃহীত
আবারো পরিষ্কার করা হলো তাজমহলকে। এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পের সফর উপলক্ষে। ট্রাম্প ও তার স্ত্রী তাজমহল দেখে মুগ্ধ হন। তাদের সফরের অন্যতম আগ্রহ ছিল তাজমহল। এ উপলক্ষে ধুয়েমুছে সাজানো হয় গোটা তাজমহল চত্বর। সপ্তাহান্তের এক প্রতিবেদনে সংবাদসংস্থা পিটিআই জানায়, আবহাওয়া জনিত সমস্ত দাগ-মুক্ত হয়েছে তাজের লাল বেলেপাথরের (স্যান্ডস্টোন) বারান্দা, ঘষেমেজে ঝকঝকে করা হয়েছে ফোয়ারাগুলো, এবং বাগানে বসানো হয়েছে বাড়তি ফুলের কেয়ারি।
তাজমহলের ‘মাড প্যাক’
পিটিআই-কে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের (আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা এএসআই) এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্রাট শাজাহান এবং তার রানী মমতাজ মহলের সমাধিতে লাগানো হয়েছে বিশেষ ‘মুলতানি মিট্টি’র প্রলেপ। দীর্ঘদিন ধরেই তাজমহলের ধবধবে মার্বেলের ওপর হলুদ ছোপ সরানোর জন্য মুলতানি মাটি ব্যবহার করে আসছে এএসআই, কারণ মার্বেলের তৈরি যেকোনো কিছুই পরিষ্কার করতে মুলতানি মাটি ব্যবহার করার প্রথা রয়েছে ভারতে।
বেশ ঘন করে লাগানো হয় মাটির প্রলেপ, যা শুষে নেয় বছর বছর ধরে জমতে থাকা তেল, ময়লা, ও পাখির বিষ্ঠা। শোষণ পর্ব শেষ হলে মাটির প্রলেপ ধুয়ে ফেলা হয় বিশুদ্ধ ডিস্টিলড ওয়াটার দিয়ে। অত্যন্ত সময় এবং পরিশ্রম সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, বলাই বাহুল্য, তবে কাজ হয় বলে বিশ্বাস করেন বহু বিশেষজ্ঞ।
প্রথমবার তাজের চেহারা মেরামত করতে এই ‘মাড প্যাক’ ব্যবহার করা হয় ১৯৯৪ সালে, ফের একবার ২০০১ ও ২০০৮ সালে, এবং শেষবারের মতো ২০১৪ সালে। গাঙ্গেয় উপত্যকায় ক্রমবর্ধমান দূষণ, এবং তাজমহলের ওপর তার প্রভাব নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং পরিবেশ কর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে চলেছেন বহু বছর ধরে।
তাজমহলের নির্মাণ শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। বলা হয়, সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃতা শাজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল তাজমহল। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত শাজাহান এবং মমতাজ। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষিত তাজমহল আজ দেশবিদেশের লক্ষ লক্ষ পর্যটকের গন্তব্য।
রঙ বদলায়
বছর দুয়েক আগে তাজমহলের পরিস্থিতি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট বলে, স্মৃতিসৌধটিকে বাঁচাতে গেলে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে “দূরে সরিয়ে রাখতে হবে”। এর আগে তাজের মার্বেলের রঙ বদলে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আদালত, এবং জানতে চায় যে কীভাবে প্রথমে সাদা মার্বেল হলুদ, এবং বর্তমানে খয়েরি এবং সবুজ, হয়ে যাচ্ছে।
এই মন্তব্যের নেপথ্যে ছিল পরিবেশবিদ এম সি মেহতার দায়ের করা একটি মামলা, যাতে দূষণের হাত থেকে তাজমহলকে রক্ষা করার আর্জি জানানো হয়েছিল। মেহতারই দায়ের করা আরো একটি আবেদনের ফলে ১৯৯৬ সালে আদালত নিদান দেয় একগুচ্ছ পদক্ষেপের, যেগুলোর মধ্যে ছিল তাজমহলের নিকটবর্তী সমস্ত কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ।
অনেক কারণেই রঙ বদলাচ্ছে তাজের। প্রথমত, কলকারখানা এবং গাড়ির ধোঁয়া। দ্বিতীয়ত, তাজমহলের পিছন দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীতে প্রবল দূষণ। যেহেতু নদীতে জলজ প্রাণী আর নেই, সেহেতু তাজমহল সমেত যমুনার পাড়ে অবস্থিত অন্যান্য ঐতিহাসিক নির্মাণের গায়েও লেগেছে জলজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের উপদ্রবের আঁচ।
ট্রাম্প দম্পতি আগ্রায় পৌঁছনোর আগে বুলন্দশহর থেকে যমুনায় ৫০০ কিউসেক (১৪,০০০ লিটার) পানি ছাড়ে উত্তরপ্রদেশ সেচ দফতর, নদীর “পরিবেশগত অবস্থার” উন্নতির জন্য।
কীটপতঙ্গের হানা
সুপ্রিম কোর্টে ২০১৮ সালে মামলার শুনানি চলাকালীন পোকামাকড়ের উপদ্রবের ফলে তাজের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি উঠে আসে।
সেসময় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মেহতা বলেন, “এই সমস্যার উৎপত্তিস্থল হলো শুকিয়ে যেতে থাকা যমুনা নদী, যার পানি আর স্বাভাবিকভাবে বহমান নয়। এএসআই-এর রিপোর্টে যেমন বলা হয়েছে, এইসব পোকামাকড় নদীর দূষিত পানিতে বাস করে, এবং সন্ধ্যার পর তাজমহলের গায়ে হামলা চালায়। আগে নদীতে মাছ থাকত, পোকা এবং তাদের ডিম খেত, কিন্তু এখন পানি এতটাই দূষিত যে নদীতে কোনোরকম জলজ প্রজাতির খোঁজ পাওয়া যায় না।”
এএসআই-এর রিপোর্টে আরো বলা হয়েছিল, প্রধানত তাজমহলের উত্তরমুখে মার্বেলের ওপর সবুজ এবং কালো ছোপ পড়েছে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির পোকার উপদ্রবে।
যমুনার পাড়ে তাজমহল ছাড়াও রয়েছে মমতাজের বাবা ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি, মেহতাব বাগ, এবং আগ্রা ফোর্ট। সবকটিই পোকার উপদ্রবে ক্ষতিগ্রস্ত, জানিয়েছিলেন মেহতা।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস