মসজিদ নিয়ে মাও সেতুংয়ের অবিশ্বাস্য দৃষ্টিভঙ্গি
মসজিদ নিয়ে মাও সেতুংয়ের অবিশ্বাস্য দৃষ্টিভঙ্গি - ছবি : সংগ্রহ
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল চীন সফরে গিয়েছিলেন সামরিক সহযোগিতা বিস্তৃত করার জন্য। ওই দলে ছিলেন তদানীন্তন ব্রিগেডিয়ার জাহানদাদ খান। পরে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য লাহোরে অবস্থানের সময় জেনারেল জাহানদাদ তার মিলিটারি সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আত্মজীবনী Pakistan Leadership Challenges -এ চীনের জনগণের সংগ্রাম ও নৈতিকতা নিয়ে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। চীনারা সব পর্যায়ে আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মোন্নয়নে কিভাবে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছে, তার বইতে সেসবের বেশ ক’টি উদাহরণ পাওয়া যায়। সে সময় বেইজিংয়ের নাম ছিল পিকিং।
জাহানদাদ তার বইয়ের ২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, চেয়ারম্যান মাও একবার সে দেশ সফরকারী একজন উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- ‘তোমরা কেবল কুরআন পড়ো, আর আমরা কুরআনের ব্যবহারিক চর্চা করি।’ তিনি নাস্তিক হলেও চীনা ভাষায় অনূদিত কুরআন পড়তেন। তিনি কুরআনের ‘ব্যবহারিক প্রয়োগ’ বলতে বুঝিয়েছিলেন, বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক বিষয়ে চীনে ইসলামের নির্দেশনাগুলো কাজে লাগানো হয়ে থাকে। যেমন- সব মানুষ সমান, অফিসের বড় কর্তা ও পিয়নের মধ্যে মর্যাদায় পার্থক্য থাকলেও মানবিক অধিকারে তারা একই কাতারে, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সবার মৌলিক অধিকার ইত্যাদি।
জীবনে যখন প্রথমবার বেইজিং গেলাম তখন চীনা সরকারের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা আমাকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করেছিলেন। তার নাম ছিল চেন। একজন প্রটোকল অফিসার ছিল আমার দেখভাল করার জন্য। একদিন আমাকে বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে নিয়ে যাওয়া হলো। ওই কর্মকর্তা নিজে সাথে গেলেন। প্রটোকল কর্মকর্তাকে পাঠালেও চলত। বিশাল স্কোয়ারে দাঁড়ালে এক দিকে মাও সে তুংয়ের ছবি দেখা যায়। তবে পুরো চীনে ওই এক জায়গাতেই তার ছবি পাবলিকলি টাঙানো আছে। ওই ছবি যেখানে টাঙানো, সেই বিল্ডিংয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়েই কমরেড মাও ১৯৪৯ সালে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই কর্মকর্তা আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন, কিভাবে লং মার্চ শেষে কমিউনিস্ট চীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিলেন।
তিনি একটি চমকপ্রদ তথ্য জানালেন। কমিউনিস্ট চীন গঠনের পর বড় বড় নেতা মিলে কতগুলো দিকনির্দেশনা তৈরি করেন। এর মধ্যে ছিল চীনে কোনো প্যাগোডা, চার্চ ও মসজিদ থাকবে না। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনে প্যাগোডাগুলোকে হয় মিউজিয়াম, নয়তো দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিবর্তন করা হবে। মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষালয়গুলোকেও বন্ধ করে দেয়া হবে। ওই ফাইল অনুমোদনের জন্য যখন চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের কাছে যায়, তিনি সব মসজিদ বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশটি কেটে দেন। একই সাথে ইসলামী শিক্ষালয়গুলোর “বেশ ক’টি চালু থাকবে” বলে সিদ্ধান্ত দেন। কী কারণে তিনি মুসলমানদের মসজিদ ও শিক্ষালয় বন্ধ না করে যেমন চলছে তেমনি চলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। অনেকেই বলেন, মাও ইসলামের নবী সা:-এর ‘জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে যাও’ বাণী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন। এ ছাড়া কয়েক শ’ বছর আগে চারজন মুসলিম অ্যাডমিরাল চীনের প্রথম নৌবহর তৈরি করে দিয়েছিলেন। দু’জন সাহাবা নবী সা:-এর জীবদ্দশাতেই চীন গিয়েছিলেন, যাদের একজনের কবর রয়েছে গোয়াংজু শহরে। চীনে মুসলমানরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী। অন্যরা ধর্ম পালন না করতে পারলেও মুসলমানরা ধর্ম পালন করতে পারে। এর অন্তর্নিহিত কারণ যাই হোক না কেন, মাও সে তুংয়ের সেই সিদ্ধান্তের জেরেই হয়তো আজো চীনে প্রায় ৪০ হাজার মসজিদ রয়েছে, যেখানে আজান হয়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হয়, প্রতিটি মসজিদে রয়েছেন ইমাম ও মুয়াজ্জিন এবং সাহায্যকারী ব্যক্তি। চীনে ইমামকে ‘মোল্লা’ বলে ডাকা হয় এবং তিনি স্থানীয় সব মুসলমানের সামাজিক নেতা হিসেবে স্বীকৃত।