সেই রিটা ফারিয়া এখন সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে যা বলেন
রিটা ফারিয়া - সংগৃহীত
তিনি রিটা ফারিয়া। ভারতের প্রথম নারী হিসেবে তিনি বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। তিনি লন্ডনে প্রমাণ করেছিলেন যে সঙ্গীতের মতো সৌন্দর্যেরও ভাষাগত কোনো সীমাবদ্ধতা নেই । ১৯৬৬ সালের ১৭ নভেম্বর লন্ডনের লাইসিয়াম বলরুমে ইতিহাস গড়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ২৩ বছর।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। ওই দিনটির স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, তিনি যে চ্যাম্পিয়ন হবেন সে রকম কোনো ধারণা তার ছিল না, তবে প্রতিযোগিতায় ওপরের দিকে স্থান করে নিতে পেরেই তিনি খুশি ছিলেন।
"ফাইনালে ১৫ জনের একজন ছিলাম আমি। তাই কিছুটা খুশিই ছিলাম একারণে যে আমি বলতে পারবো আমাকে প্রথম ১৫ জনের একজন হিসেবে বাছাই করা হয়েছে।"
রিটা ফারিয়া বার্ষিক মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে লন্ডনে গিয়েছিলেন ভারতের মুম্বাই শহর থেকে।
তিনি বলেন, "বিউটি কুইন বলতে সাধারণত যা বোঝায় আমি সেরকম কিছু ছিলাম না। কিন্তু আমার অনেক বড় শখ ছিল এই শিরোপা জেতার। প্রতিযোগিতায় যারা অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যে, বুকিদের হিসেবে, আমার জয়ের সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে কম।"
মুম্বাই শহরে, একসময় যা বোম্বে নামে পরিচিত ছিল, বেড়ে উঠেছেন তিনি। শৈশব থেকেই তার স্বপ্ন ছিলো একজন ডাক্তার হওয়ার।
"আমার বয়স যখন ৬/৭ বছর তখন অ্যাজমা হয়েছিল। হাসপাতালের লোকেরা চিকিৎসা দিতে বাড়িতে আসতো। তাদের কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ ছিলাম। ঠিক ওই সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমিও সে রকম কিছু করতে চাই।"
তিনি বলেছেন, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মতো চিন্তা ভাবনা তার মাথায়ও কখনো ছিলো না।
তিনি বলেন, "মেক-আপ কিম্বা পোশাক আশাক - এসব বিষয়ে আমার কখনো আগ্রহ ছিলো না।"
"সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আমি দাঁত ব্রাশ করে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতাম। কখনও আয়নার দিকে তাকাইনি। কিন্তু তখন অনেকেই আমার সৌন্দর্য নিয়ে মন্তব্য করতো।"
"আমার বয়স যখন ১৬ বছর, মায়ের সঙ্গে একটা রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। তখন আমাকে দেখে একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক এগিয়ে এলেন। তিনি আমার মায়ের কাছে জানতে চাইলেন ছবিতে অভিনয়ের জন্যে তারা আমাকে কোনো প্রস্তাব দিতে পারেন কীনা।"
"তাদের এই কথায় মা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।"
মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা শুরু হয় ১৯৫০ এর দশকে। ব্রিটেনের একটি বিনোদন বিষয়ক কোম্পানি মেকা এর আয়োজক।
সেসময় এটি পরিণত হয়েছিল টেলিভিশনের একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে। সারা পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ এই শো উপভোগ করতো।
সেই ১৯৬৬ সালেই ভারত প্রথমবারের মতো মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একজন 'মিস ইন্ডিয়া' খুঁজে বের করার জন্য তখন ভারতের পাঁচটি শহরে আয়োজন করা হয় প্রতিযোগিতার।
রিটা ফারিয়া ছিলেন মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। তার বোনই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন মিস বোম্বে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্যে।
"সে আমাকে বললো, তুমি কেন যাচ্ছো না? কে জানে তুমি হয়তো লন্ডনেও চলে যেতে পারো! তখন ছবি তোলার জন্যে সে আমাকে একজন ফটোগ্রাফারের কাছে নিয়ে গেল। সেই ছবি পাঠানো হলো। দেখা গেল যে শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে ফাইনালের জন্যে বাছাই করেছে।"
মিস বোম্বে প্রতিযোগিতায় শাড়ি পরে অংশ নিয়েছিলেন রিটা ফারিয়া। পরে মিস ইন্ডিয়া নির্বাচিত হয়েছিলেন সাঁতারের পোশাক সুইমস্যুট পরে।
কারণ আয়োজকরা জানতে পেরেছিল যে লন্ডনের ফাইনালেও তাকে এই পোশাক পরতে হবে।
তিনি বলেন, "জীবনে এই প্রথম সুইমস্যুট পরে প্যারেডে অংশ নিয়েছিলাম। সেটা এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার ছিল। লোকজন অবাক হয়নি।"
"মিস বোম্বে প্রতিযোগিতা হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে, তার পরের মাসেই হলো মিস ইন্ডিয়া। এই দু'মাস কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। কেউই কিছু বুঝতে পারেনি। আমিও বুঝতে পারছিলাম না।"
"কিন্তু যখন একটার পর আরেকটা প্রতিযোগিতায় জিতে গেলাম - তখন আমি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।"
লন্ডনে আসার কথা রিটা ফারিয়ার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু ভারত যেহেতু এই প্রথমবারের মতো এরকম একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাচ্ছিল, অনেকেই তাকে সমর্থন করেনি।
"আমি সবকিছুই সোজা ভাবে নিয়েছিলাম। সবার কাছেই আমি গিয়েছিলাম হাসি মুখে। কিন্তু আমি যেহেতু ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছিলাম, তাই আরো একটু সাহায্য সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছিলাম।"
তিনি বলেন, "রিহার্সাল রুমে আয়োজকরা আমাকে বললো, যে সুইমস্যুট আমি পরেছিলাম সেটা নাকি আমার উপযোগী ছিল না। এটা তো আরেক জনের কাছ থেকে ধার করতে হয়েছিল এবং সেটা ঠিক মতো আমার গায়েও লাগেনি।"
সেবছর মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন ৫১ জন প্রতিযোগী। এক পর্যায়ে রিটা পৌঁছে গেলেন প্রথম সাত জনের তালিকায়।
"সাতজনের মধ্যে আমি আছি। তার মানে আমি কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি। তারা পঞ্চম, চতুর্থ, তৃতীয়, দ্বিতীয় জনের নাম ঘোষণা করলো।"
"দ্বিতীয় হিসেবে যার নাম ঘোষণা করা হলো, আমি ভেবেছিলাম, তিনি-ই মিস ওয়ার্ল্ড নির্বাচিত হবেন। তিনি ছিলেন মিস ইয়োগোস্লাভিয়া। বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম যে তারা ঠিক মেয়েটিকে নির্বাচন করতে পারেনি।"
"তারা আমার নাম ঘোষণা করলো এবং আমি সত্যিই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।"
রিটা ফারিয়াকে ঘোষণা করা হলো বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নারী হিসেবে। তারপরেও পড়াশোনাকেই তিনি অগ্রাধিকার দিলেন। বললেন, কোনো ছবিতে অভিনয় করতে রাজি নন তিনি।
বিনোদন কোম্পানি মেকা চাইলো তাদের মিস ওয়ার্ল্ড সরাসরি মেডিকেল কলেজে ফিরে না গিয়ে পরের বছরে তাদের হয়ে কাজ করুক। মার্কিন কমেডিয়ান বব হোপের সাথে তাকে কাজের প্রস্তাব দেয়া হলো।
"আমি আর ফিরে যাইনি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো কমেডিয়ান বব হোপের সাথে মিস ওয়ার্ল্ড ভিয়েতনামে যাবেন ক্রিসমাসের সময় সৈন্যদের বিনোদন দিতে। ভারত সরকার এতে খুশি ছিলো না," বলেন তিনি।
"কারণ ভিয়েতনাম যুদ্ধে তারা আমেরিকাকে সমর্থন করেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি ইতোমধ্যেই মেকার সাথে এক বছরের চুক্তিতে সই করে ফেলেছি। আমাকে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার পক্ষে প্রচারণা চালাতে হবে।"
"এর পর আমি ভিয়েতনামে চলে যাই এবং এনিয়ে বিতর্ক চলতে লাগলো। মেকা আমার পাসপোর্ট আটকে রাখলো। তারা আমাকে ভারতে ফিরতে দিল না।"
মেকার এই সিদ্ধান্ত খুব সহজে মেনে নিতে পারেননি রিটা ফারিয়া। পরের বছরে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর কথা থাকলেও তিনি জানতেন যে তাকে মেডিকেলের পড়া শেষ করতে হবে। কারণ এটাই ছিল তার জীবন আসল স্বপ্ন।
তিনি বলেন, "ওই বছরটা আমার জন্যে খুব কঠিন ছিল। কারণ পরিবারের সদস্যরা কেউ পাশে ছিল না। আমার নিজেরও তেমন কিছু ছিল না।"
"একটা সুটকেসকে ঘিরেই বেঁচে ছিলাম আমি। পরবর্তী মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার আগে মেকা আমার কাছে জানতে চাইলো আমি লন্ডনে মেডিকেলের পড়াশোনা শেষ করতে চাই কীনা। তখন আমি সাথে সাথেই সেটা লুফে নিলাম।"
রিটা ফারিয়াই প্রথম একজন ডাক্তার যিনি মিস ওয়ার্ল্ড নির্বাচিত হয়েছেন। লেখাপড়া শেষ করার সময় তিনি তার হবু স্বামী ডেভিড পাওয়েলকে খুঁজে পান। এই দম্পতি ১৯৭৩ সালে ডাবলিনে চলে যান।
রিটার দুই মেয়েও মেডিকেলে পড়েছেন। এখন তার পাঁচজন নাতি নাতনি। কিন্তু এখনো তিনি অত্যন্ত গর্বের সাথেই মিস ওয়ার্ল্ড জয়ের দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন।
"আমি যে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছি তাতে আমি অবশ্যই গর্ব অনুভব করি। ভারতের জন্যেও আমি গর্বিত। সেবছর সবসময় আমি শাড়ি পরেছি কারণ আমি ভারতের একটা ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয় আমি সেটা করতে পেরেছি।"
এই সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে বর্তমানে অনেক সমালোচনা ও বিতর্ক হয়। অনেকেই এধরনের প্রতিযোগিতা আয়োজনের বিপক্ষে। তাদের যুক্তি এখানে নারীকে পণ্য হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
রিটা ফারিয়াও মনে করেন আজকের পৃথিবীতে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার কোন জায়গা নেই। তিনি বলেছেন, "এর দিন শেষ হয়ে গেছে। কারণ পৃথিবী এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ক। রূপকথা বলেও এখন আর কিছু নেই।"
সূত্র : বিবিসি