সিপিইসি ও পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক
সিপিইসি - সংগৃহীত
বর্তমান সময়ের একটি বহুল আলোচিত বিষয় হলো পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)।সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. আবদুল হাফিজ শেখ চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) সম্পর্কে ব্যাখ্যা ও একে কার্যপযোগী করা নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
তিনি চীন ও পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে ‘বড় বড় তথ্য’ জ্ঞাপন করে, বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিবেশ, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও সিপিআইয়ের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। তিনি এই প্রকল্পের পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন।
প্রায় ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যা নিরেয় চীনের বর্তমান জিডিপি ১২ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের (১৯ ট্রিলিয়ন ডলার) পরই চীনের অবস্থান। জাপান, রাশিয়া, ভারত ও ব্রাজিলের মোট জিডিপির চেয়ে চীন এগিয়ে আছে।
চীন হলো সবচেয়ে বেশি বৈশ্বিকভাবে একীভূত অর্থনীতির দেশ। এর বাণিজ্য বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। ১৯৭০-এর দশক থেকে দেং জিয়াওপিং ও তার উত্তরসূরীরা যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তাতেই উত্থান ঘটে চীনা অর্থনীতির।
চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য পরিমাপ করা যায় দু’ভাগে : ১. গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হার দিয়ে, যা ১৯৭৮ সাল থেকে প্রায় ৪০ বছর ধরে ১০ ভাগের কাছাকাছি। এবং ২. ৮০ কোটি লোককে দারিদ্র্যসীমা থেকে তুলে আনা। কত লোকের জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করার হিসাব দিয়ে যদি নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হয, তবে দেং জিয়াওপিং হবেন ২০ শতকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের এই অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মাথাপিছু আয় বাড়ানো নিয়ে কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। চনের মাথাপিছু জিডিপি হলো ৯ হাজার ডলার। এর ফলে বৈশ্বিক র্যাং কিংয়ে তার স্থান ৭১। দেশটি সুইজারল্যান্ড (৮০ হাজার ডলার), যুক্তরাষ্ট্র (৬০ হাজার ডলার), সিঙ্গাপুর (৫৭ হাজার ডলার), জার্মানি (৪৪ হাজার ডলার), জাপান (৩৯ হাজার ডলার) ও তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার (উভয়ের ১০ হাজার ডলার) চেয়ে অনেক পেছনে রয়েছে।
চীনের শক্তিশালী গড় দক্ষতা দেশের ভেতরে তার আয় বৈষম্যকে আড়াল করে রাখে। শ্যাঙঝাই, তিয়ানজিন, বেইজিং, শেনজিনের মতো অঞ্চলগুলো অপরগুলোর চেয়ে ভালো করছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য ৩:১ এবং উপকূল ও ভূবেষ্টিত এলাকার মধ্যে ২:১। কিছু লোকের যেখানে ২০ হাজার ডলার, সেখানে অন্যদের ৫ হাজার ডলার। এর ফলে যে আঞ্চলিক ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে তা সামাজিক সম্প্রীতি ও বন্ধনের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে।
চীনের সাফল্য কাহিনীর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, পরবর্তী পর্যায়ের নেতাদের কাছে সাবলীলভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং সুশৃঙ্খল ও অব্যয়বহুল কর্মীবাহিনী। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চীনের বিক্রি করার সক্ষমতা (রফতানি ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার) এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকার ফলে দেশটিতে বিলিয়ন বিলিয়ন বিনিয়োগ আসা।
ভারতের মতো অনেক দেশের সাথে তাদের তীব্র বিরোধ থাকলেও ওইসব দেশ থেকেও তারা উপকৃত হয়। চীন হলো ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার (৮৫ বিলিয়ন ডলার)। গত বছর চীনে ভারতের রফতানি বেড়েছে ৪০ ভাগ।
হাফিজ শেখ জানান যে, পাকিস্তানের জনসংখ্যা হলো ২১ কোটি, বর্তমান জিডিপি ০.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু জিডিপি ১,৬৩০ ডলার। পাকিস্তান বিশ্বে ১৪০তম স্থানে আছে। আর এর ঐতিহাসিক প্রবৃদ্ধি হার গড়ে ৫ ভাগের কম।
কিন্তু পাকিস্তান তার পুরো ইতিহাসে জাতীয় আয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সময়কাল সৃষ্টি করতে পারেনি। চার বছরের বেশি কোনো প্রবৃদ্ধি স্ফুরণ স্থায়িত্ব পায়নি। সব সরকারের আমলেই অব্যাহত ব্যর্থতার কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈশ্বিক ও এমনকি আঞ্চলিক অর্থনীতির সাথে একীভূত হতে পারেনি। রফতানি বা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ব্যাপারেও দেশটি সফল হয়নি।
পুরো ইতিহাসজুড়েই পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল সোনার হরিণ। কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই তার মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। এর জন্য দেশকে বেশ মূল্য দিতে হয়েছে। আর এতে করে দেশের অর্থনীতি গতিশীলতা হারিয়েছে।
তবে গত কয়েক বছর ধরে সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নির্বাচন হচ্ছে। গতবার অনেক সাবলীলভাবে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। নাগরিক সমাজ বেশ সোচ্চার, সুসংগঠিত শক্তি। দেশের সম্ভাবনা বিপুল। বিশেষ করে খনিজসম্পদ, কয়লা, পানি, গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ থাকায় ও তিন অঞ্চলের মাঝখানে দেশটির অবস্থান হওয়ায় পাকিস্তান বেশ সম্ভাবনাময়।
আশা করা হচ্ছে যে সিপিইসি বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। বৈশ্বিক জিডিপি ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৫ ভাগ ও ২০১৮ সালের জন্য আইএমএফের ৩.৯ ভাগ প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানকে নিয়ে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে।
তবে শেখের মতে, এই আশাবাদের নিচেই আছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। ক্রমবর্ধমান হারে সরকারি ঋণ বেড়ে তা বিপজ্জনক মাত্রায় চলে গেছে। চীনের বেসরকারি ঋণ খুব বেশি মনে করা হয়ে থাকে। অনেক দেশ মারাত্মক ভারসাম্যহীনতায় ছুটছে। চীন, জার্মানি ও জাপান কঠিন কারেন্ট একাউন্ট উদ্বৃত্তে রয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রয়েছে কঠিন কারেন্ট একাউন্ট ঘাটতিতে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো অংশে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও রক্ষণশীলদের বাগাড়ম্বরতা বৈশ্বিক আর্থিক স্থাপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ব্রিটেন ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় কয়েকটি ইউরোপিয়ান দেশে কট্টরপন্থীরা নির্বাচনে সাফল্য পাচ্ছে। এর ফলে বাণিজ্য যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নিম্নগামী করছে। বহুত্ববাদ ও এমনকি মুক্তবাণিজ্য পর্যন্ত প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কানেকটিভিটি, বাণিজ্য সংস্থান, অঞ্চল ও মহাদেশজুড়ে বাজার ও বাণিজ্য একীভূত করার প্রস্তাব করেছন। তার ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চীন ও ইউরোপ/এশিয়ার মধ্যে কানেকটিভিটি ও সহযোগিতাকে কেন্দ্র করেই।
বেল্ট বলতে আসলে স্থলভাগ বোঝাচ্ছে, রোড বলতে সাগরপথকে বোঝানো হচ্ছে। স্থলভাগের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. ইউরেশিয়ান ল্যান্ড ব্রিজ (পশ্চিম চীন থেকে পশ্চিম রাশিয়া), ২. জিনজিয়াঙ থেকে জার্মানি পর্যন্ত রেলওয়ে (কাজাখস্থান, রাশিয়া ও পোল্যান্ড হয়ে), ৩. চীন মঙ্গোলিয়া রাশিয়া করিডোর (উত্তর চীন থেকে পূর্ব রাশিয়া পর্যন্ত), ৪. মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া করিডোর (পশ্চিম চীন থেকে তুরস্ক), ৫. ইন্দো-চীন করিডোর (দক্ষিণ চীন থেকে সিঙ্গাপুর)। এসব প্রকল্প এশিয়া প্যাসিফিক, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের ৬৮টি দেশকে যুক্ত করবে, যা বিশ্বের জিডিপির ৪০ ভাগ।
সমুদ্র সিল্ক রোড দক্ষিণ চীন সাগর, দক্ষিণ প্যাসিফিক মহাসাগর, ও বৃহত্তর ভারত মহাসাগরের মধ্যে কানেকটিভিটি জোরদার করবে।
লেখক : প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক