বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ও বিএসএফর ভূমিকা
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ও বিএসএফর ভূমিকা - ছবি : সংগ্রহ
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন খুবই চমৎকার বলে মনে করা হয়। ১৯৭১ পরবর্তী ফারাক্কা বাঁধ, সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতীয় সাহায্যসহ বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বেশ উষ্ণ বলেই প্রচার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ততটা সুখকর বলে মনে হয় না। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা এই দাবির যৌক্তিকতাকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে উভয় সরকারের মাথাব্যথা না থাকলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত সম্পর্কে বিরূপ ধারণা ক্রমেই বাড়ছে। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিতর্কিত ‘শ্যুট-অন-সাইট’ নীতি দীর্ঘ দিন থেকেই অনুসরণ করে আসছে। ফলে বিএসএফকে কারণে-অকারণে বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করার অবাধ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। আত্মীয়স্বজনদের সাথে যোগাযোগ, হাট-বাজারে কেনাকাটার জন্য অনেক মানুষের সীমান্ত পারাপার জরুরি হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে কৃষিজমিতে কৃষিকাজ বা নদীতে মাছ ধরার জন্যও অনেক মানুষকে সীমান্ত পেরুতে হয়। এসব ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ হিসেবেই দেখা হয় সীমান্ত এলাকায়। এমতাবস্থায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের ‘দেখামাত্র গুলি’র ক্ষমতা চর্চা বন্ধুত্বের সম্পর্কের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
স্বাধীনতার পর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সবসময়ই অশান্ত ছিল এবং এখনো রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৫০০ সাধারণ ও বেসামরিক বাংলাদেশী হত্যার অভিযোগ রয়েছে বিএসএফের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গুলিবর্ষণের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি বিএসএফ সন্দেহভাজনদের আক্রমণাত্মক ভীতি প্রদর্শন, নির্দয়ভাবে প্রহার এবং নির্যাতন করে আসছে। বিগত ১০ বছরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। এদের বেশির ভাগই বাংলাদেশী। অনেক ক্ষেত্রে নিরস্ত্র এবং অসহায় স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ডের স্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বরাবরই এসব হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে আসছে। এ বিষয়ে বিএসএফের সাবেক প্রধান রমণ শ্রীবাস্তবের মন্তব্য খুবই দুঃখজনক। তার ভাষায়, “কোনো মানুষের উচিত নয় এই শিকারগ্রস্তদের জন্য দুঃখ করা। তিনি দাবি করেন, যেহেতু এসব ব্যক্তি প্রায়ই রাতে, অবৈধভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করছিল, তাই তারা মোটেই ‘নির্দোষ’ ছিল না।” তার বক্তব্য সত্য হলেও বিনাবিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বরং তা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ৬৪ জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে বিএসএফ গুলি ও শারীরিক নির্যাতনে হত্যা করেছে ৪২ জন বাংলাদেশীকে। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে ৩১২ বার হামলা চালানো হয়। এতে ১২৪ জন বাংলাদেশী নিহত হন। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন নিহত, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন, ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হন। ভারত প্রতিনিয়তই সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। আর গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে।
বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিটি সম্মেলন বা বৈঠকেই সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনা বা বন্ধ করা নিয়েও আলোচনা এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে উভয় পক্ষই দীর্ঘ দিন ধরে দাবি করে আসছে। সম্প্রতি দিল্লি সফর শেষে ঢাকায় ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে হত্যা নিয়ে বলেছেন, বিএসএফ মহাপরিচালক তাকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে বলে দৃশ্যমান নয়। বিজিবি মহাপরিচালকের দাবি মতে, ২০১৯ সালে সীমান্তে ৩৫ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। বিএসএফের হিসাবে এই সংখ্যা আরো কম। আর সরকারি হিসাবে ২০১৮ সালে সীমান্তে তিনজন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। ২০১৭ সালে ১৭ জন। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরো বেশি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন। আহত হয়েছেন ৪৮ জন। অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৪ জন। আর ২০১৭ সালে ২৪ জন। সরকারি হিসাব ধরলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে ১২ গুণ। আর বেসরকারি হিসাবে আরো বেশি। যা রীতিমতো উদ্বেগজনকই বলতে হবে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি যে খুবই উদ্বেগজনক তা ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠনের বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’-এর প্রধান কীরিটি রায়ের বক্তব্য হলো, ‘আগে বিএসএফ বলত আমাদের ওপর আক্রমণ করতে এলে আমরা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছি। লাশ ফেরত দিত। এখন আর তাও বলে না। গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়।’ তার ভাষায়, ‘ভারত তো একটা হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারা তো সীমান্ত হত্যা বন্ধ করবে না। সীমান্তে মুসলমানদের মারছে। আর ঠেলে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। আমরা প্রতিটি ঘটনার প্রতিবাদ করছি। কিন্তু বাংলাদেশের দিক থেকে শক্ত কোন প্রতিবাদ দেখতে পাচ্ছি না। মেরে দিচ্ছে কোনো বিচার নেই।’
বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে সীমান্ত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলেই মনে হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন থেকে সে চিত্রই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুসারে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএসএফ হত্যা করেছে ৩৫ জনকে। এ সময় বিএসএফ ২২ বাংলাদেশীকে গুলি ও নির্যাতন করে আহত করেছে আর অপহরণ করেছে ৫৮ জনকে। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে ভারতীয়রা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তিন বাংলাদেশীকে জোর-জবরদস্তি অপহরণ করে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশীকে। আহত হয়েছেন ৬৮ জন। এ ছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে। তিন বছরে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যায় ২০১৫ সাল শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৪৫ জন বাংলাদেশীকে।
চলতি বছরের শুরুতেই নিহতের সংখ্যা ১০ জনে পৌঁছে গেছে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৩। যুদ্ধাবস্থা ছাড়া বন্ধুভাবাপন্ন দুই দেশের সীমান্তে এ রকম প্রাণহানি অস্বাভাবিক, অমানবিক। বিভিন্ন সময় ভারতীয় শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার নীতিতে কাজ করা হবে। সীমান্ত হত্যা রোধে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র দেয়া হবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। বিএসএফের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয় যে, বিএসএফ সদস্যরা সাধারণ নাগরিকের ওপর গুলি ছোড়ে না। অস্ত্রধারী চোরাকারবারিরা দল বেঁধে জোয়ানদের ওপর আক্রমণ করে, তখন তারা আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণে বাধ্য হয়। কিন্তু এ যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের অনেকে চোরাচালানি হলেও তারা সশস্ত্র আক্রমণকারী এ কথা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবার নিয়ে সীমান্তের উভয় পাড়েই রয়েছে অসাধু বাণিজ্যের বিস্তার। কিন্তু প্রতিটি ঘটনাতেই নিরস্ত্র বাংলাদেশীরা শুধু নিহত হচ্ছেন। পার পেয়ে যাচ্ছে ওপারের সন্ত্রাসীরা। দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা এবং এ সম্পর্কিত চুক্তি অনুযায়ী যদি কোনো দেশের নাগরিক অননুমোদিতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে, তবে তা অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা এবং সেই মোতাবেক ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নিয়ম রয়েছে। যেখানে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, মানুষ পাচার এবং চোরাচালান বন্ধে যৌথ উদ্যোগ ও দু’দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও আস্থা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে দুই দেশ কাজ করছে, সেখানে সীমান্তে গুলি-হত্যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। সীমান্তে যেকোনো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিদ্যমান আইনে বিচার হবে এবং এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত।
সম্প্র্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘সীমান্তে হত্যা নিয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। বিজিবি-বিএসএফের বৈঠকেও সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গতি গুরুত্ব দিয়ে উত্থাপন করা হয়েছে।’
মুখে এসব কথা বললেও এ ক্ষেত্রে তারা তেমন সাফল্য দেখাতে পারছে না বরং সরকারের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণেই সার্বিক পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এর দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
সীমান্ত হত্যা বন্ধের জন্য বিষয়টি অনতিবিলম্ব আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা দরকার। অন্যথায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
smmjoy@gmail.com