প্রসঙ্গ : আলেমদের মধ্যে বিভাজন
বায়তুল মোকাররম মসজিদ - ছবি : সংগ্রহ
সাম্প্রতিক সময়ে গোষ্ঠীচেতনা, সম্প্রদায়গত বিভেদ, সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি, দলীয় উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বজনীন চিন্তার ঘাটতি, পরমতের প্রতি অশ্রদ্ধা সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো অসহিষ্ণুতার প্রধান কারণ। অসহিষ্ণুতা একটি ব্যাধি যা ব্যক্তির অহংবোধ থেকে তৈরি হয় এবং ভালোবাসার বদলে হিংসা ও ঘৃণা ছড়িয়ে সমাজদেহকে জরাগ্রস্ত করে দেয়। অসহিষ্ণুতার অপসংস্কৃতির সাথে, হিংসা, বিদ্বেষ, জনপ্রিয়তা ও অর্থ-বিত্তের সম্পর্ক জড়িত। পরমতের প্রতি অসম্মানের এ ভয়াবহ ব্যাধি পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, এমনকি ধর্মীয় পরিমণ্ডলেও বিস্তৃত হচ্ছে। উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতার চর্চা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেলে মানুষকে সামাজিক বৈরিতা বৃত্তবন্দী করে ফেলে। তখন পৃথিবী মানুষের আবাসযোগ্যতা হারায়। বিনয়, সৌজন্য, মানবিক আচরণ ও ভ্রাতৃত্বের ঐতিহ্য দিয়ে এ ব্যাধিকে নির্মূল করতে হবে। ‘শত ফুল ফুটতে দাও’। পৃথিবী আবাসযোগ্য হোক প্রকৃত মানুষের।
একজন সমাজ বিশ্লেষক ও রাজনীতি বিজ্ঞানীর মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, ‘একটি বহুত্ববাদী, উদার, গণতান্ত্রিক জাতি-সমাজ গঠনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যে ধরনের টানাপড়েন চলতে থাকে তাতে অসহিষ্ণুতার নানা ক্ষেত্র নির্মিত হয়। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণের চ্যালেঞ্জের পথ পাড়ি দিতে হয় বহু স্বার্থগোষ্ঠীর অসহিষ্ণু অবস্থানকে ডিঙিয়ে। কখনো লিঙ্গচেতনার লড়াই, সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব, আবার কখনো শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার পরিসরে দলগত রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যেও অসহিষ্ণুতার উদ্ভব হয়।’
কোনো বক্তা যদি হেলিকপ্টারে চড়েন এটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক মন্তব্যের ঝড় ওঠে। এ দেশের ‘যদু মধু’রা হেলিকপ্টারে চড়তে পারলে জননন্দিত কোনো ব্যক্তি চড়লে অসুবিধা কোথায়? এক দিনে একজন জনপ্রিয় বক্তাকে একাধিক মাহফিলে শরিক হতে হয়। বা হেলিকপ্টার তাদের জন্য বিলাসিতা নয়, অপরিহার্য বাহন। যা হোক আলেমদের প্রতি সম্মান দেখাতে কেন আমরা কার্পণ্য করি? কারো মাহফিলে যদি উপচেপড়া মানুষের ভিড় হয় তাতে আমাদের খুশি হওয়ার কথা। ব্যান্ডপার্টি ও ডিজে কালচার থেকে যুব সম্প্রদায় ওয়াজ মাহফিলের দিকে ছুটতে শুরু করেছে। এটা আশার সঞ্চার করে। অপরদিকে, অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মনকে ছোট করে দিচ্ছে। জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ। এ অনুগ্রহ ও দয়ার প্রতি সম্মান দেখাতে না পারলে, তা কেড়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে।
আবহমানকাল ধরে শীতের মৌসুমে এ দেশের শহর ও গ্রামঅঞ্চলে ওয়াজ, তাফসির, জিকির, মিলাদ, সিরাত মাহফিলের প্রথা চালু রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাহফিলের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। সাধারণ মানুষ ওয়ায়েজদেরকে সম্মানের চোখে দেখে। তাদের মুখে পবিত্র কুরআন, হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস শুনে শ্রোতাদের মন বিগলিত হয়, ঈমানি চেতনা হয় জাগ্রত এবং মানুষ নেক আমলে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সমাজে তাওহিদের আদর্শ, নৈতিকতা ও তাকওয়ার ভিত তৈরি করার ক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিলের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। মাদকাসক্তি, জুয়া-ক্যাসিনো, অশ্লীলতা, সন্ত্রাস, যৌতুক, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে ওয়ায়েজ ও বক্তারা সোচ্চার। অন্যদিকে, ইসলাম ধর্মীয় মাজহাবি বিরোধ ও ইখতিলাফি মাসায়েলগুলো প্রকাশ্যে আলোচনা করলে অসহিষ্ণুতা নতুন মাত্রা পায়। পরবর্তীতে তা সঙ্ঘাতে রূপ নেয়। যদি একান্ত আলোচনা করতেই হয় তাহলে পবিত্র কুরআন, সহিহ হাদিস ও ফকিহদের ভিন্নমতগুলোও ব্যাখ্যা করা জরুরি।
ইদানী ওয়াজ মাহফিলের চিরায়ত প্রবনতার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। কৌতুক, হাস্যরস, দৃষ্টিকটু দেহভঙ্গি, অনির্ভরযোগ্য কিসসা কাহিনী, বিশেষ কোনো গায়িকা-নায়িকার গানের নকল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে, ওয়াজ কিছুটা বিনোদনের রূপ নিয়ে দূর অজানার পথ ধরেছে। ওয়াজের সুরের একটি বিশেষ আবেদন রয়েছে। সুরের লহরী ও তরঙ্গায়িত মূর্ছনায় শ্রোতাদের সম্মোহিত করে রাখা যায়। সুললিত কণ্ঠস্বর আল্লাহতায়ালার বিশেষ দান। এটাকে জনগণের মনের পরিবর্তন এবং নৈতিকতার উজ্জীবনে ব্যবহার করা গেলে সুফল পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষ সুরের পাগল। তাদের মতে, ওয়াজ হলো সুরের টান। অপর দিকে এমন বক্তা ও ওয়ায়েজ আছেন যাদের কথায় সুর নেই, আছে সুধা; লয় নেই, আছে অমৃত। আছে পবিত্র কুরআন হাদিসের তাত্ত্বিক আলোচনা, নিগূঢ় পর্যালোচনা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। কথা সাদামাটা ও বক্তব্য সরাসরি হওয়ায় নেক আমলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। তাদের চাহিদা আছে শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে। মাদরাসায় শিক্ষিত হয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বক্তারা যখন মাঠে আসেন তখন সমাজে নতুন চাহিদা তৈরি হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বেদনার সাথে লক্ষ করা গেছে যে, কোনো কোনো ওয়ায়েজ প্রকাশ্য মাহফিলে অপর আলিম ও ওয়াজের বিরুদ্ধে বিষোদগার, কঠোর সমালোচনা, রূঢ় শব্দ ব্যবহার প্রভৃতি অন্যায় কাজও করেছেন। এক অপরকে রাসূলের সা: দুশমন, তাগুতের দোসর, গোমরাহ, বিদেশী এজেন্ট ও ইহুদির দালাল, এমন কি কাফের বলার ধৃষ্টতাও দেখানো হচ্ছে। তাদের অনুসারীরা ফেসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের ঝড় তুলে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে যাচ্ছেন। এসব কারণে আদালতে মামলা পর্যন্ত রুজু হয়েছে। সচেতন মহল মনে করে পরিস্থিতিকে আর বাড়তে দেয়া যায় না। এখনই এর লাগাম টেনে ধরার সময়। এ বিষয়ে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর হাইকমান্ড, সর্বজনশ্রদ্ধেয় বুজুর্গ পীর এবং ওলামা মাশায়েখের হস্তক্ষেপ সময়ের দাবি। অতীতের লালিত অসহিষ্ণুতার অর্গল ভেঙে দিতে হবে। ব্যক্তির নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহনশীল সমাজ বিনির্মাণের এটা অপরিহার্য পূর্বশর্ত।
যেমন ভিন্নমত থাকতে পারে, তেমনি ভিন্নমতের পাশাপাশি তৃতীয় মত থাকতে পারে। তবে একাডেমিক পর্যালোচনা করতে গিয়ে মাত্রাজ্ঞানের সীমা যেন আমরা ছাড়িয়ে না যাই, সেদিকে সবিশেষ লক্ষ্য রাখা দরকার। আমরা কি পারি না আমাদের যেকোনো ভাইয়ের ভালো ও ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ এবং মন্দ ও নেতিবাচক দিকগুলো বর্জন করতে? আমরা কি দিলের দরদ নিয়ে ভাইয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধনের ব্যবস্থা করতে পারিনা? এর জন্য প্রয়োজন উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও পক্ষপাতহীন পর্যবেক্ষণ।
মতের ভিন্নতা, সাধারণ বিষয়ে ইখতিলাফ (মতানৈক্য) ও মাজহাবি বিরোধ নিয়ে আমরা যুগে যুগে ভ্রাতৃঘাতী সঙ্ঘাত ও সহিংসতায় রক্ত ঝরিয়েছি যা এক বিভীষিকাময় স্মৃতি। মুফাসসিরে কুরআন ইমাম ইবনু জারির আত তাবারি রহ:কে বাগদাদের কবরস্থানে দাফন করতে দেয়া হয়নি। ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল রহ: এর কথিত অনুসারীরা এটা করেছেন। নিজ বাড়ির উঠানে তাঁকে কবর দিতে হয়েছে। দামেস্কের মসজিদে নির্মম পিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারান বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিস ইমাম নাসাঈ রহ:। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম বুখারি রহ:কে মাতৃভূমি বুখারা থেকে বের করে দিয়েছিলেন তাঁর স্বধর্মাবলম্বীরাই। সরকারের সাথে যোগসাজশ করে হাফেয ইবন তাইমিয়া রহ:কে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন একশ্রেণীর ‘আলিম’। আব্বাসী খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহ তথা সুন্নিদের শায়েস্তা করার জন্য মোঙ্গল নেতা হালাকু খানকে বাগদাদে ডেকে এনেছিলেন শিয়াপন্থী প্রধানমন্ত্রী ও তার লোকেরা। ফলে বিধ্বস্থ হয়ে গেল সভ্যতার পাদপীঠ, ঐতিহাসিক নগরী বাগদাদ; জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল ৫০০ বছরের সমৃদ্ধ পাঠাগার ও লাখ লাখ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি; মারা যায় বাগদাদ নগরীর ২০ লাখের মধ্যে ১৬ লাখ মানুষ। স্পেন বিজয়ী সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন জিয়াদের সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছিলেন উমাইয়া খলিফারা। জীবনের শেষ দিনগুলোতে আরবের রাস্তায় তাদের ভিক্ষা করতে দেখা গেছে। নির্মমতা ও অসহিষ্ণুতা আর কাকে বলে? বর্তমান শতকের বিশ্ববরেণ্য মনীষী সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ: এর বিরুদ্ধে আরবি ভাষায় বিরাট গ্রন্থ রচনা করা হয়েছিল। সর্বশেষ ঘটনায় ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ শায়খুল ইসলাম বিচারপতি মুফতি তকি ওসমানীকে হত্যা করার জন্য তার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। তিনি বেঁচে গেলেও তার দেহরক্ষী প্রাণ হারান। এভাবেই তৈরি হচ্ছে বিভেদ ও বিরোধের কঠিন প্রাচীর।
যারা তাকলিদে বিশ্বাসী এবং ইমাম আজম আবু হানিফা রহ:-এর অনুসারী, তারা ইমাম শাফেয়ি রহ:, ইমাম মালেক রহ:, ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল রহ:, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ:, আল্লামা ইবনুল কাইয়িম আল জাওজিয়া রহ:, শায়খ আবদুল্লাহ ইবনু বাজ রহ:, শায়খ মুহাম্মদ সালিহ আল উসায়মিন রহ: প্রমুখের ফিকহি গবেষণাকে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখি। অপর দিকে, গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের মধ্যে অনেকে (সবাই নয়) মুকাল্লিদদের এবং বিশেষত ইমাম আজম আবু হানিফা রহ:এর প্রতি তীর্যক ভাষায় বিষোদগার করে থাকেন। তা কেবল বেদনাদায়ক নয়, লজ্জাজনকও বটে। এর জবাব দিতে গিয়েও আমরা সীমা লঙ্ঘন করে বসি। সঙ্কীর্ণতার দুষ্ট কীট উদারতার সম্ভাবনাকে করেছে দংশিত ও ছিন্নভিন্ন। উম্মাহর ঐক্যের পথে এ মনোবৃত্তি বিরাট অন্তরায়স্বরূপ। আমরা নিজেদের দল, গোষ্ঠী, মত ও চিন্তাধারার নির্ধারিত গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি। দলীয় অন্ধত্ব ও সঙ্কীর্ণতার বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়েছি। এ প্রক্রিয়া পদ্ধতিতে নিজেদের দল ভারি হলেও মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে এবং প্রকারান্তরে লাভবান হচ্ছে বৈরী শক্তি।
ওলামা-মাশায়েখ পারস্পরিক ছোটখাটো মতভেদ ভুলে কওম ও মিল্লাতের বৃহত্তর স্বার্থে একতাবদ্ধ হতে পারলে বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করা যায়। ইতিহাসের পাঠকদের জানা আছে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল আন্দোলনের মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা? কিন্তু তৎকালীন সেক্যুলার রাজনীতিক ও উচ্চাভিলাসী মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসি ছিল রাষ্ট্রকে ইসলামীকরণের বিপক্ষে। তারা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, বিভিন্ন ঘরানার আলিমরা পরস্পর দলাদলি ও মত বিরোধে বিপর্যস্ত এবং ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুসরণে প্রত্যেক তরিকার নিজস্ব ব্যাখ্যা বিদ্যমান। তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন করতে গেলে সাংঘাতিক বিভাজন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।’
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
ওমর গনি এম ই এস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম