আগ্রাসী আগুনে পুড়ছে মিয়ানমার
সু চি ও মিন হ্লাইঙ - সংগৃহীত
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে কয়েকটি দেশের মূল ভূখণ্ডে সত্যিকারের নির্বাচন হয়, তাদের একটি হলো মিয়ানমার। আবার এই দেশটিরই কম্বোডিয়া ও লাওসের মতো দেশগুলোর তুলনায় জনসাধারণের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার প্রবণতা বেশি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবেশী সরকারগুলো এসব সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হলেও মিয়ানমার সরকার তার কাজ করে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে যেমন রয়েছে স্কুলবর্ষ এক মাস বৃদ্ধি, তেমনি রয়েছে জানুয়ারিতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় বড় ধরনের কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ।
তবে দেশটি তার জনসাধারণের বেশ নোংরা কিছু আকাঙ্ক্ষার প্রতিও নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। সত্যিকার অর্থেই ২০২০ সালের শেষ দিকে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটিতে জাতীয়তাবাদ ধুয়া তুলেছে। আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক (মিয়ানমারে ২০১০-এর দশকে পরিবর্তনের সূচনাকারী) থিন সিন প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে তার তুলনামূলকভাবে অখ্যাত দল সামরিক সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির পক্ষে প্রচারণায় নেমে।
জানুয়ারিতে ইউএসডিপির সদরদফতরে হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ছদ্মাবরণে নব্য উপনিবেশবাদের কারণে আমাদের দেশ বিদেশীদের দখলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে দেশটিকে শিগগিরই পুরোপুরি গিলে ফেলবে বিদেশীরা।
ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে ইয়াঙ্গুনে জাতীয়তাবাদীরা সমাবেশ করে। আর কমান্ডার-ইন-চিফ একটি শক্তিশালী বৌদ্ধবাদী সংস্থার কাছ থেকে সম্মানসূচক স্বীকৃতি পেয়েছেন। সিনিয়র জেনারেল মিন আঙ হ্লাইঙের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ইয়ং মেন্স বুড্ডিস্ট এসোসিয়েশন ‘বর্ণ, ভাষা ও ধর্ম’ রক্ষায় তার ভূমিকার জন্য তাকে পুরস্কৃত করেছে।
ওই সভা নিয়ে খবর প্রকাশ করার কারণে জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলো দুটি স্থানীয় মিডিয়াকে হুমকি দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। খিট থিট মিডিয়া এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তারা ওই সমাবেশের এক আয়োজকের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছে। জাতীয়তাবাদী সন্ন্যাসীরা শেষ রাতে ৭ ডেস নিউজ ডেইলির কার্যালয়ে যাওয়ার পর মিডিয়াটি এর কভারেজ থেকে সরে এসেছে।
আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ যেকোনো রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই উদ্বেগজনক বিষয়। তবে মিয়ানমারের মতো গোলযোগপূর্ণ দেশে তা বিশেষভাবে সমস্যার সৃষ্টি করে। এই দেশটিতে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। জানুয়ারির ওই অনুষ্ঠানে থিন সিনের বক্তৃতার পর শ্রোতারা তাদের হাত তুলে x অবয়ব প্রদর্শন করে। এর মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গা ও গাম্বিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, ছো্ট্ট আফ্রিকান দেশ গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য মিয়ানমারকে বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে।
ফেব্রুয়ারির সমাবেশে জাতীয়তাবাদীরা ‘নো রোহিঙ্গা’ পরিভাষা ব্যবহার করে একে ভুয়া জাতিগত গ্রুপ হিসেবে অভিহিত করে। মিয়ানমার আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের জাতিগত গ্রুপ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এর বদলে তারা এদেরকে বাঙালি ও অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অভিহিত করছে।
ইউএসডিপিও ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) তীব্র সমালোচনা করেছে ইয়াঙ্গুনের মুখ্যমন্ত্রী তার এক বক্তৃতায় রোহিঙ্গা পরিভাষাটি ব্যবহার করায়। কঠোর ভাষায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আক্রমণ করার জন্য তারা এনএলডিকে আক্রমণ করে। এতে বলা হয়, বাঙালিরা ব্যাপকভাবে সব উপায়ে (স্থল, সাগর ও আকাশপথ ব্যবহার করে) মিয়ানমারে প্রবেশ করছে।
ইউএসডিপি ২০১৫ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়েছিল। তারা পার্লামেন্টর উচ্চকক্ষে মাত্র ৫ ভাগ আসন পেয়েছিল। আরেকটি শোচনীয় বিপর্যয় এড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে তারা আগ্রাসী বক্তব্য দিচ্ছে। আর মিয়ানমারে নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে, তা বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এসব বাগাড়ম্বড়তার বাস্তব পরিণাম থাকায় রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্নই হতে পারে।
রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক খিন মঙ বলেন, ২০২০ সালের নির্বাচনে নিরাপত্তা নিয়ে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। এটি রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের অন্য কোনো গ্রুপের জন্য নিরাপদ হবে না।
তিনি আরো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী মরিয়া হয়ে বন্দুক ব্যবহার করে ক্ষমতা আবার নিয়ে নিতে পারে।
দি ডিপ্লোম্যাট