মার্কিন-তালেবানে কী হচ্ছে?
মার্কিন-তালেবানে কী হচ্ছে? - সংগৃহীত
আফগান শান্তিপ্রক্রিয়া এখন সঙ্কটজনক পর্যায়ে রয়েছে। তালেবান এবং আমেরিকানদের মধ্যকার আলোচনায় আগামী কয়েক সপ্তাহে কী ঘটে, তার ওপরই আফগানিস্তান পুনরায় স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে অগ্রসর হবে, নাকি ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে যে যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত চলছে, সেটাই অব্যাহত থাকবে তা নির্ধারিত হবে। যা হোক না কেন, এমনকি তালেবান এবং আমেরিকানরা একটি চুক্তিতে পৌঁছতে সক্ষম হলেও, তালেবান এবং আফগান সরকার সংলাপের মাধ্যমে একটি শান্তিচুক্তিতে পৌঁছতে পারলেই কেবল স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। স্পষ্টত দু’টি প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি ভিন্ন। আফগান-মার্কিন আলোচনা এবং আন্তঃআফগান সংলাপ ঘনিষ্ঠভাবে একই সূত্রে গাঁথা হলেও উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তাদের পথের বাধাগুলো এড়িয়ে যাওয়া কারো উচিত হবে না। সুতরাং দোহা থেকে কিছু ইতিবাচক খবর পাওয়া গেলেও আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ার সফলতার ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
আফগানিস্তানকে যৌক্তিকভাবেই ‘সাম্রাজ্যবাদের কবর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। (অধুনালুপ্ত) সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে ১৯৭৯ সালে দেশটি দখল করার মাধ্যমে নিজেদের যে ক্ষতি করেছে সেটা তারা ইতিহাসের শিক্ষাকে অবজ্ঞা করেই করেছে। মুসলিম বিশ্ব এবং পশ্চিমাদের সহায়তায় প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত আফগান জিহাদ স্থায়ী হওয়ার পর ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান আগে উপদেশ দিয়েছিলেন- রাজনীতির প্রথম হুকুম বা নির্দেশ হলো, ‘আফগানিস্তান আক্রমণ বা দখল করো না।’ ১৯৯০ এর দশকের অধিকাংশ সময় নষ্ট হয়েছে বিভিন্ন আফগান সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যকার আন্তঃযুদ্ধ ও সঙ্ঘাতে। ওই সময় ইরান উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে এবং পাকিস্তান তালেবানদের সমর্থন দিয়েছিল। আর তালেবানরা ছিল সম্পূর্ণ রূপে পশতুন উপজাতীয় বংশোদ্ভূত। আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান এবং ইরানের মধ্য প্রক্সি ওয়্যার ও তীব্র লড়াই শুরু হয়। উভয় দেশই আফগানিস্তানের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করে ভুল পথে পরিচালিত হয়। এর ফলে ‘৯/১১’ ট্র্যাজেডি এবং ২০০০ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের ঘটনা ঘটে। আশা করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং থিংক ট্যাংকের উপদেশ মেনে নিয়ে আফগানিস্তানের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পাকিস্তান ও ইরানের ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই আশা মরীচিকায় পরিণত হয়েছে।
দৃশ্যত, আমেরিকার সহজ জয়ে এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করে ওয়াশিংটন গর্ব ও অহঙ্কারে ফেটে পড়েছিল। ফলে তারা আফগান ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে যায় এবং আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে সেখানে ১৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে আটকা পড়ে থাকে। আমেরিকা তাদের ইতিহাসের দীর্ঘতম এই যুদ্ধে খুব কমই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে। যুদ্ধে তাদের শত শত কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য জীবন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে আফগানিস্তানে তার সেনা মোতায়েনের জন্য অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০২ সালের এপ্রিলে এক বিবৃতির মাধ্যমে ঘোষণা করেন, তিনটি লক্ষ্য সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছে। এগুলো হলো : আলকায়েদাকে পরাজিত ও ধ্বংস করে দেয়া, তালেবান সরকারের স্থানে আফগানদের নিয়ে ওয়াশিংটনের পছন্দ অনুযায়ী একটি সরকার গঠন করা এবং একটি স্থিতিশীল সরকারের মাধ্যমে আফগানিস্তানকে পুনর্গঠিত করা। তাদের ভাষায় বসবাসের জন্য একটি অধিকতর উত্তম স্থান হিসেবে আফগানিস্তানকে পুনর্গঠন করা হবে। কার্যত যুক্তরাষ্ট্র আলকায়েদাকে পরাজিত এবং তুলনামূলকভাবে সহজে তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাবুলে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তালেবানদের অব্যাহত বিদ্রোহ এবং আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অভাবে আমেরিকা ‘বসবাসযোগ্য একটি অধিক ভালো স্থান’ হিসেবে স্থিতিশীল সরকারসহ আফগানিস্তানকে পুনর্গঠনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল তা ব্যর্থ হয়ে যায়। আফগানিস্তানে আমেরিকার ব্যর্থতার কারণ অনুধাবন করাটা কঠিন কিছু নয়।
আফগানিস্তানে আমেরিকা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তা অর্জনে মার্কিন নীতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা গেছে। মার্কিন নীতিতে সম্ভবত সবচেয়ে মৌলিক ভুল ছিল, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অবহেলা করে একচেটিয়াভাবে সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করা।
আমেরিকা তালেবানদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা ও শক্তিমত্তাকে অত্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার কারণে আমেরিকার মনোযোগ এবং সামরিক ব্যবস্থাপনা আফগানিস্তান থেকে অন্য দিকে সরে যায়। এতে তালেবানরা পুনর্গঠিত হয়ে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আমেরিকার রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি তালেবানদের একটি বৈধ রাজনৈতিক গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত না করে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করেও আমেরিকা ভুল করেছে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এক ভাষণে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ করাও প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত না করা পর্যন্ত, অর্থাৎ ২০১১ সাল শুরুর আগ পর্যন্ত তালেবানদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে। আমেরিকানরা তাদের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য ও জাতিগোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। ওয়াশিংটন এই বাস্তবতাকে অনুধাবন করলে তারা বুঝতে পারতো, যারা কাবুলে সরকার গঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, তারা শেষ পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। কারণ দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে পশতুন জাতিগোষ্ঠীর। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে তালেবানদের অধিকাংশই হচ্ছে পশতুন। অপর দিকে আমেরিকার সমর্থিত কাবুল সরকারে তাজিক, হাজারা এবং উজবেক জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা রয়েছেন।
ধর্মের প্রতি অনুগত ও অধিকতর রক্ষণশীল আফগান সমাজে আমেরিকা ও কাবুল সরকার কর্তৃক পশ্চিমা মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয়ার কারণে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে তালেবানদের প্রতিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে।
আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, তালেবান এবং আফগানিস্তানের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে একটি উপসংহারে উপনীত হতে পারে। আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, পশতুন/তালেবান বা অন্য জাতিগোষ্ঠীÑ কেউ এককভাবে দেশটিতে শান্তি ফেরাতে পারবে না।
তাই প্রধান প্রধান জাতি গোষ্ঠীগত সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলা উদ্ভাবন করতে হবে। তৃতীয়ত, ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের ব্যাপারে আমেরিকা কোনো মতামত চাপিয়ে দিতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র কেবল আফগান দল ও গ্রুপগুলোকে শান্তিপ্রক্রিয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে পারে। চতুর্থত, আফগানিস্তানে শান্তি চুক্তি সাথে সাথে দেশটি থেকে অবশ্যই মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সেখানে অব্যাহত মার্কিন সামরিক উপস্থিতির কোনো প্রয়োজন নেই। আর আফগান ভূখণ্ড থেকে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপকে তৎপরতা চালানোর অনুমতি না দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। পঞ্চমত, ১৯৯০ এর দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে আফগান শান্তি চুক্তিতে প্রতিবেশী দেশ, বিশেষত পাকিস্তান এবং ইরানের সমর্থন অবশ্যই থাকতে হবে এবং সাথে সাথে এই শান্তিচুক্তির প্রতি আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের মতো বৃহৎ শক্তিগুলোর আশীর্বাদ থাকাও প্রয়োজন। পাকিস্তান ও ইরানকে অবশ্যই ১৯৯০-র দশকে তারা আফগানিস্তান নিয়ে যে ভুল করেছিল এর পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে যেতে হবে।
তালেবান ও মার্কিন প্রতিনিধিদের উল্লিখিত সীমারেখার মধ্যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা, যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, আন্তঃআফগান সংলাপ শুরু করার ব্যাপারে একটি পন্থা ঠিক করতে হবে। পাকিস্তানকে অবশ্যই সংলাপ প্রক্রিয়ায় তাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা অব্যাহত থাকতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত এবং লাহোর, ‘কাউন্সিল ফর ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স’-এর প্রেসিডেন্ট দ্য নেশন পত্রিকা থেকে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার