যুক্তরাষ্ট্র-ভারত : যেখানে তারা শত্রু, যেখানে মিত্র
মোদি ও ট্রাম্প - সংগৃহীত
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই একে অপরের প্রশংসা উচ্চস্বরে বলতে থাকে এই বলে যে তাদের অভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বিরুদ্ধে তারা হলো ‘গণতান্ত্রিক দেশ’ ও ‘কৌশলগত অংশীদার’। কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়েই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একই অবস্থানে নেই। বাণিজ্য প্রশ্নে রয়েছে মারাত্মক বিরোধ। আঞ্চলিক কৌশলগত ইস্যুগুলোতেও তারা পুরোপুরি একমতে নেই।
এর কারণ হলো দুই দেশে লোকরঞ্জকবাদ ও জাতীয়তাবাদের উত্থান। জাতীয়তাবাদের প্রতিযোগিতায় দুই দেশের মধ্যে বিভেদকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আগের চেয়ে তা এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান। কারণ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন কট্টর লোকরঞ্জক-জাতীয়তাবাদী দুই নেতা। ভারতে হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বন্ধুপ্রতীম মোদি যুক্তরাষ্ট্র ও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হয়তো যাচ্ছেন না। কিন্তু তিনি ভারতের অর্থনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করার মতো বিদেশী স্বার্থ কিংবা ভারতের নিজস্ব বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ খর্ব করে এমন কিছুকে অনুমোদন না করার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) ও অন্যান্য ‘হিন্দুত্ববাদী’ সংস্থাগুলোর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জাতীযতাবাদীদের কাছ থেকে চাপের মুখে রয়েছেন। একইভাবেই ট্রাম্প অন্যান্য দেশের বিপরীতে আমেরিকার ও আমেরিকার বাণিজ্য ও রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন এবং ওই স্লোগান দিয়েই ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছেন।
এই দ্বৈততাই, তথা কোনো একটি বিষয়ে একই সমতলে থাকার প্রয়োজনীয়তায় এবং অপর ইস্যুতে আলাদা থাকার দরকারই ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের ভারত সফরের ফলাফল নির্ধারণ করবে।
একদিকে ট্রাম্পের অভ্যর্ত্থনা হবে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ এবং তা এমনকি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মোদিকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় দেয়া ‘হাউডি মোদি’ ইভেন্টকেও ছাড়িয়ে যাবে। টেক্সাসের হিউস্টনের একটি স্টেডিয়ামে হওয়া ওই অনুষ্ঠানটিতে প্রায় ৫০ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছিল। ভারত সফরের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে ট্রাম্প গর্বভরে বলেছেন যে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের আহমদাবাদে তাকে স্বাগত জানাবে ৭০ লাখ লোক। ৭০ লাখ হলো আহমদাবাদের ৮০ ভাগ লোক। আর হিউস্টনের ‘হাউডি মোদি’র মতো করে মোদি সদ্য নির্মিত আহমদাবাদ স্টেডিয়ামে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়ামটির ধারণ ক্ষমতা এক লাখ। ভারতীয় মিডিয়া আউটলেট ডব্লিউআইওএনের মতে, আহমদাবাদে তিন ঘণ্টা অবস্থানের জন্য খরচ হবে ১২০ কোটি রুপি (১৬.৭ মিলিয়ন ডলার)। খরচের মধ্যে রয়েছে রাস্তার পাশে থাকা বস্তিগুলো যাতে ট্রাম্পের চোখে না পড়ে সেজন্য আধা কিলোমিটার প্রাচীর নির্মাণ।
প্রাথমিকভাবে প্রত্যাশা ছিল যে ট্রাম্প ও মোদি একটি নতুন মেগা বাণিজ্যচুক্তি করবেন, মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির (এফটিএ) ভিত্তি স্থাপন করবেন, বিদ্যমান মতপার্থক্যের অবসান ঘটিয়ে একটি বিনিয়োগ চুক্তি করবেন। কিন্তু ওই বেলুন ফুটিয়ে দিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, ভারতের সাথে হয়তো আমাদের একটি বাণিজ্যচুক্তি হবে। তবে আমি আসলে কিছু সময় পরে, হয়তো নির্বাচনের আগে বড় চুক্তিটি করব। ভারতীয় পক্ষ তাতে সম্মতি দিয়ে বলেছে যে উভয় দেশই চায় তাড়াহুড়া না করতে। কারন নতুন চুক্তির দীর্ঘ মেয়াদি পরিণতি রয়েছে।
এর ফলে ট্রাম্পের ৩৬ ঘণ্টার সফরটিকে ভাষ্যকারেরা ‘তামাশা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে যেমন বিপুল সংবর্ধনা দিয়েও বলতে গেলে কিছুই পাওয়া যায়নি, এখানেও তেমনই কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি বাজার (১৬ ভাগ) ও তৃতীয় বৃহত্তম আমদানির দিক থেকে (৬.৩ ভাগ)। এ দিক থেকে প্রথম স্থানে আছে চীন (১৪.৬ ভাগ), ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (১০.২ ভাগ)। কিন্তু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেশ কিছু মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে।
কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের (সিআরএস) জন্য পেপার রচনাকারী শায়েরাহ ইলিয়াস আখতারের মতে, ভারত নির্দিষ্ট কিছু স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের ওপর আরোপ করা উচ্চ হারের শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধাও ফেরত চায় ভারত। কৃষি, গাড়ি, প্রকৌশল ইত্যাদিসহ ভারতীয় পণ্যের জন্য মার্কিন বাজারে আরো প্রবেশাধিকার চায়।
অন্য দিকে, যুক্তরাষ্ট্র চায় তার কৃষি ও ম্যানুফেকচারিং পণ্য, দুগ্ধজাত সামগ্রী, মেডিক্যাল ডিভাইসের ভারতীয় বাজারে প্রবেশের বৃহত্তর বাজার। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রেৃর বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৮-১৯ সময়কালে যা ছিল ১৬.৯ বিলিয়ন ডলার।
ভারতের শুল্ক বিপুল, বিশেষ করে কৃষি খাতে। ২০১৯ সালের জুনে মার্কিন জিএসপি যোগ্যতা হারানোর পর বাদাম, আপেল, কেমিক্যালসের ১.৪ বিলিয়ন ডলারের বাজারের ওপর প্রভাব ফেলেছে ভারতের উচ্চ হারে করারোপ। তাছাড়া নন-ট্যারিফ বাধাও আছে। এছাড়া এ দুই দেশ ডব্লিউটিওতেও একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করছে।
ভারত ২০১৮ সালে ছিল জিএসপির বৃহত্তম সুবিধাভোগী। এই কর্মসূচির আওতায় মার্কিন শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভারত থেকে মার্কিন পণ্য আমদানির এক দশমাংশ (৩ বিলিয়ন ডলার) আনা হযেছিল। জিএসপি অপসারণ করে এখন শুল্কারোপ করা হয়েছে ১ থেকে ৭ ভাগ পর্যন্ত।
ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িক ভিসা নীতি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ভারতীয়দের ওপর প্রভাব ফেলছে। ডব্লিউটিওতে শ্রমিকদের জন্য মার্কিন ফিকে চ্যালেঞ্জ করছে, এইচ-১৮ (বিশেষজ্ঞ শ্রমিক) সংশোধনে সম্ভাব্য মার্কিন পদক্ষেপের ওপর নজর রাখছে ভারত।
ভারতে স্যানেটারি ও ফাইটোস্যানেটারি (এসপিএস) প্রতিবন্ধকতাগুলোও মার্কিন কৃষি পণ্যের রফতানির লাগাম টেনে ধরছে। দুই দেশই একে অপরের কৃষি সহায়ক কর্মসূচিকে ‘বাজার ধ্বংসকারী’ বিবেচনা করছে। ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা উদ্বেগ মার্কিন স্বার্থকে জটিল করে তুলছে।
মেধাসত্ত সুরক্ষা নিয়ে মতানৈক্য অবসান ঘটাতে চাচ্ছে দুই দেশ।
প্রতিরক্ষা চুক্তি কাজ করছে ভালোভাবেই
আখতার অবশ্য বলেছেন যে, তবে প্রতিরক্ষা খাতে যুক্তরাষ্ট্র ভালো করছে। দুই দেশ ২০০৮ সাল থেকে ১৫ বিলিয়ন যলারের বেশি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করেছে। অথচ এর আগের সময়কালে সবমিলিয়ে ছিল ৫০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশিত বিক্রির মধ্যে রয়েছে ২৪টি এমএইচ-৬০ সিহক মাল্টিরোল নৌ হেলিকপ্টার (২.৬ বিলিয়ন ডলার) ও অতিরিক্ত ৬টি এএইচ-৬৪ অ্যাপাচে অ্যাটাক হেলিকপ্টার (৯৩০ মিলিয়ন ডলার)। আরো বেশি প্রযুক্তি-শেয়ার করা ও যৌথ উৎপাদনের উদ্যোগের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ভারত।
অবশ্য, আখতার উল্লেখ করেছেন যে প্রতিরক্ষা খাতে আরো বেশি উচ্চতর এফডিআই সুবিধা প্রদান করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের রুশ নির্মিত এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্রয়ের ফলে সিএএটিএসএ-আইনের অধীনে অবরোধের মুখে পড়তে পারে দিল্লি
রাজনৈতিক-কৌশলগত মাত্রা অগ্রাহ্য
কৌশলগত বিষয়াদিতে এসব বিশেষায়ন মনে করিয়ে দেয় যে ট্রাম্প প্রশাসন অনেক বেশি বাণিজ্যমুখী এবং ভারতের সাথে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৌশলগত বিষয়াদি ধরতে পারছে না। দক্ষিণ, দক্ষিণ পূর্ব ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলে চীন ও রাশিয়াকে প্রতিরোধ করার জন্য ভারতকে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু এই বিষয়টিই স্থানীয় বাণিজ্য স্বার্থের বেদিতে বলি দেয়া হয়।
কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ভারতীয় বিশেষজ্ঞ অ্যাশলে টেলিস শীর্ষস্থানীয় এক পররাষ্ট্রবিষয়ক ম্যাগাজিনে বলেছেন, ওই বিষয়টি নিয়ে ভারত বা অন্য কোনো দেশের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের কোনো সমন্বিত নীতি নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও মূলত স্থানীয় অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকেই নিবেদিত। নির্বাচনী সুবিধা হাসিলের জন্য স্থানীয় বাণিজ্য ও শিল্প লবিগুলোর দাবিও ভারত সরকারকে মানতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয় দেশেই নিয়মিত নির্বাচন হয়ে থাকে, দুই দেশেই রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে। দুই দেশের লোকরঞ্জকবাদ ও জাতীয়তাবাদের সম্মিলনেই তাদের মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।