টাইম স্কেল কেলেঙ্কারি : ফেঁসে যাচ্ছেন তারা
টাইম স্কেল কেলেঙ্কারি : ফেঁসে যাচ্ছেন তারা - নয়া দিগন্ত
জালিয়াতি করে প্রাথমিকের ১৭৭ শিক্ষককে টাইমস্কেল প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যহার করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন এমপি। একই সাথে সারা দেশে প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল প্রদানে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কী না তা জানতে অধিদফতরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ও ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৭৭ শিক্ষককে টাইম স্কেল দেয়া হয়। এতে সরকারের কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী রেজা ও ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আলেয়া ফেরদৌস সিন্ডিকেট করে এ টাইমস্কেল দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। টাইমস্কেল বঞ্চিত কয়েকজন শিক্ষককের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো: জাকির হোসেন প্রাথমিকভাবে খোঁজখবর নিয়ে ঘটনার সত্যতা পান। এরপর গত মঙ্গলবার অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের সচিবকে তিনি নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ছিল ১৩ ও প্রশিক্ষণবিহীনদের ১৪তম তথা তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকদের পদ দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বেতন গ্রেড ১১তম ও প্রশিক্ষণবিহীনদের ১২তম নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিলেকশন গ্রেড স্কেল ও উচ্চতর স্কেল (টাইমস্কেল) বা কোনো স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর পর এক বছর পরে পরবর্তী উচ্চতর বা টাইমস্কেল প্রদানসংক্রান্ত বিধান বিলুপ্তি করা হয়েছে। নতুন করে জারি করা বিধানে বলা হয়, কোনো স্থায়ী কর্মচারী পদোন্নতি ব্যতিরেকে একই পদে ১০ বছর পূর্তিতে এবং চাকরি সন্তোষজনক হওয়া সাপেক্ষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১১তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হবেন। স্থায়ী কর্মচারী চাকরির ১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্তির পরবর্তী ছয় বছরে পদোন্নতিপ্রাপ্ত না হলে সপ্তম বছরে চাকরি সন্তোষজনক হওয়া সাপেক্ষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্ত হবেন। চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত এই ধারা প্রযোজ্য হবে। এ ছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের টাইমস্কেল প্রদানের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি জারি করা আদেশে বলা হয়, প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের মাধ্যমে দিতে হবে। কমিটিতে অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা থাকতে হবে।
পরের বিধান অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল প্রাপ্তির সুযোগ নেই। কারণ, ২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার পর তাদের বেতন স্কেলের দু’টি ধাপে উন্নীত করা হয়েছে। একই গ্রেডে আট বছর চাকরির সময় অতিক্রান্ত না হওয়ায় নতুন টাইমস্কেল দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু নীতিমালা লঙ্ঘন করে গত বছরের ১১ জুলাই দু’টি আদেশে রাজবাড়ি জেলার সদর উপজেলার ২৮ জন, ২ জুলাই পৃথক আদেশে কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার ১৯ জন, ২৭ জুন মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার দু’জন ও কিশোরঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার একজন, ১৪ জুলাই টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার ৯ জন ও ঘাটাইল উপজেলার ১০ জন, ৪ জুলাই টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ১৩ জন, ২৬ জুন টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার ২৯ জন ও সখিপুর উপজেলার ১২ জন, ২৫ জুন পৃথক আদেশে মানিকগঞ্জের ২২ জন, ১১ জুলাই পৃথক আদেশে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ১৩ জন, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ১৯ জন প্রধান শিক্ষককে টাইমস্কেল দিয়েছেন।
গত বছরের ৩১ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় উপপরিচালকরা এ বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। তাতে তারা উল্লেখ করেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রদানসংক্রান্ত কমিটির দ্বিতীয় শ্রেণীর তথা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রদান অথবা তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে কর্মরত থাকাকালীন কর্মকাল একত্রে মিলে টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড দিতে পারবেন কি না। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিত টনক নড়ে মন্ত্রণালয়ের। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রদানের বিষয়ে গত ২৭ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মো: বদরুল হাসানের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সভা করে উপপরিচালকদের প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল দেয়ার ক্ষমতা স্থগিত করেন। একই সাথে আগের চিঠির পরে কোনো প্রধান শিক্ষককে টাইমস্কেল দিলে সে আদেশ স্থগিত করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক গতিশীলতা ও সেবার মান বাড়াতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল প্রদানের ক্ষমতা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের বিভাগীয় উপপরিচালকদের দেয়া হয়। এ সুযোগে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় ও ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস মিলে এ জালিয়াতি করেছে।