কী হচ্ছে ইদলিবে?
কী হচ্ছে ইদলিবে? - ছবি : সংগ্রহ
সিরিয়ার ইদলিবের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একমাত্র প্রদেশ হচ্ছে ইদলিব। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এই প্রদেশটিতে সম্প্রতি সরকারি বাহিনী ও তুর্কি বাহিনীর মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। সরকারি বাহিনীর হামলায় পাঁচ তুর্কি সেনা নিহত হয়েছে। এরপর তুরস্ক পাল্টা হামলা চালিয়ে বহু সরকারি সৈন্যকে হত্যা করার দাবি করেছে। রাশিয়ার সমর্থনে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইদলিব এবং আলেপ্পোতে সামরিক অভিযান শুরু করে সিরিয়ার সামরিক বাহিনী। এই সামরিক অভিযানের মুখে ইদলিবে মানবিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রায় সাত লাখ মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘ বলেছে, সেখানে সহিংসতায় গত কয়েক সপ্তাহে শত শত বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। গত মাসে ইদলিবে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হামলায় তুরস্কের অন্তত ১৩ সৈন্য নিহত হয়। এরপর এ মাসে আবার সেখানে কয়েক জন তুর্কি সৈন্য নিহত হয়েছে। এরপর তুরস্ক সমর্থিত বিদ্রোহী বাহিনীর পাল্টা হামলায় সরকারি বাহিনীর ৫১ সৈন্য নিহত হয়েছে বলে তুরস্ক দাবি করেছে। ইদলিবে পূর্বাঞ্চলে তফেতানজ বিমানবন্দরে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটিতে সিরীয় সৈন্যদের কামানের আঘাতে ১০ তুর্কি সেনা হতাহত হয়।
সিরিয়ার তুর্কি সৈন্য নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান সিরিয়াকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন। আর কোনো তুর্কি সৈন্য আক্রান্ত হলে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ওপর যেকোনো স্থানেই তুরস্ক হামলা চালাবে। পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন। এরদোগান বলেন, চলতি মাসের শেষের দিকেই সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে ইদলিবের তুর্কি পর্যবেক্ষণ এলাকার বাইরে পাঠাতে তুরস্ক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। উল্লেখ্য, ইদলিবে তুরস্কের ১২টি পর্যবেক্ষণ চৌকি রয়েছে। ২০১৮ সালে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করে তুরস্ক এসব চৌকি স্থাপন করেছিল। সে সময় রাশিয়া ও তুরস্কের এ চুক্তিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার। সিরিয়ার সেনাবাহিনী জানিয়েছে ইদলিবে তাদের অগ্রগতি রোধ করার চেষ্টা করছে তুর্কি বাহনী। তারা ও তুর্কি বাহিনীর হামলার জবাব দিচ্ছে বলে জানায়।
সাম্প্রতিক কয়েক সাপ্তাহে ইদলিবে বাশার আসাদের নিষ্ঠুর ও জঘন্য হামলার কারণে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে তাতে সাত লাখের ও বেশি বেসামরিক লোক তাদের বাড়ি-ঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
বাশার আসাদের এই গণহত্যা অভিযানকে মিয়ানমারের গণহত্যার সাথে তুলনা করা যায়। সিরিয়ার দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে অর্ধেকই এখন গৃহহীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। আর এদের মধ্যে ইদলিবের অনেক মানুষ ও রয়েছে। এখন ইদলিবের অসহায় মানুষদের সাহয্যের জন্য যে সহায়তা সেখানে যাচ্ছে তা খুবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। এখন ভূ-রাজনৈতিক কারণে ইদলিবে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তুর্কি সৈন্যদের সাথে সিরিয়ার সরকারি সৈন্য ও ইরানি প্রক্সিদের মধ্যে যে সঙ্ঘাত চলছে এই সহিংসতার কারণে ৩০ লাখ শরণার্থী তুরস্কের দিকে পালিয়ে যেতে পারে বলে হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, তুরস্ক ইতোমধ্যে ৩৫ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
এদিকে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সিরিয়া ও ইরাকের সর্বত্র ইরানি টার্গেটে হামলা চালাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড ও ইসরাইল আমেরিকার যৌথ প্রচেষ্টার অংশ। সিরিয়াভিত্তিক আই আর জিসির ওপর কয়েক ডজন হামলার মধ্যে সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড অন্যতম। তুরস্ক কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কারণে কুর্দিরা আমাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কুর্দিরাও সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে চায়। এতে করে সিরিয়া ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
অপর দিকে রাশিয়া ও তুরস্ক বিপরীত পক্ষে থাকলে ও সিরিয়ার প্রভাব হ্রাস করার ব্যাপারে তারা আবার একমত। প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং এরদোগান ২০১৮ সালে সোচিতে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তাতে তারা ইদলিবকে বেসামরিক অঞ্চলে পরিণত করা এবং তুর্কি ও রুশ সেনারা সেখানে টহল দেয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। ইদলিবের সর্বশেষ সঙ্ঘাত ও সহিংসতার পর উভয় নেতা টেলিফোনে কথা বলেছেন। এরমধ্যে রাশিয়ার একটি প্রতিনিধিদল এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূত জেফ্রি আনকারা আন্ধারা সফর করেছেন। মস্কো ইদলিবের ব্যাপারে সিরিয়া সরকার যাতে সহিংসতার পথ পরিহার করে সে ব্যাপারে আসাদকে বাধ্য করতে পারে। পুতিনের জন্য এখন এরদোগানের সাথে সুসম্পর্ক রাখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আঙ্কারা এবং মস্কো ইদলিবের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসতে পারলে তাদের অবশ্যই সিরিয়া-ইরানি প্রভাব হ্রাস করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। তেহরান সিরিয়া যুদ্ধকে পুঁজি করে আঞ্চলিক মোড়ল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে চায়। এটা মোটেই কাম্য নয় বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে।
সিরিয়ার মানবিক বিপর্যয়ে ছয় লাখের ও বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর পর্যবেক্ষকরা পরে প্রাণহানির সংখ্যা আরো কত হচ্ছে- তা নিয়ে আর তেমন হিসাব-নিকাশ করেননি। সম্ভবত এ সংখ্যা এখন ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া ১০ লাখেরও বেশি মানুষ আহত, মানসিকভীতি এবং অর্থহীন ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ও বিপর্যস্ত।
রাশিয়া, ইসরাইল, ইরান, তুরস্ক সব দেশেই নিজেদের স্বার্থে সিরিয়াকে নিয়ে খেলছে। বাশার আল আসাদ সফল হলে সেখানে মানবিক বিপর্যয় আরো বাড়বে। আসাদের গণহত্যায় রাশিয়া ইরান অব্যাহতভাবে সহায়তা করলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। সিরিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও উদ্বেগজনক। এরদোগান ইদলিব নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথেও টেলিফোন করেছেন। উভয়ে আলোচনায় দামেস্কের হামলার নিন্দা করেছেন বলে জানিয়েছে তুর্কি প্রেসিডেন্টের কার্যলয়ে। সিরিয়া প্রশ্নে তুরস্ক যেভাবে সাহসিকতার সাথে ঝুঁকি নিয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। মুসলিমবিশ্বে বিভাজন থাকলে ও সিরিয়ার মানবিক বিপর্যয় প্রতিরোধে ওআইসি ও জাতিসঙ্ঘকে অবশ্যই এগিয়ে আসা প্রয়োজন।