কসোভো : অনেক আশা নতুন নেতার ওপর
কসোভো : অনেক আশা নতুন নেতার ওপর - ছবি : সংগ্রহ
প্রায় চার মাস ধরে চলছিল রাজনৈতিক বিরোধ। গত ৩ ফেব্রুয়ারি দৃশ্যত এই বিরোধের অবসান হয়েছে। এ দিন নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন পার্লামেন্ট সদস্যরা। এতে আলোড়ন সৃষ্টি করে ৬৬ ভোট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন আলবিন কুর্তি। আর বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের বিরোধিতা করে পার্লামেন্ট থেকে ওয়াক আউট করে। গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে ২৯টি আসনে জয় পায় আলবিন কুর্তির লেফট-উইং সেলফ-ডিটারমিনেশন মুভমেন্ট। তবে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের একেবারে শেষ প্রান্তে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার বিভিন্ন অংশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ভেঙে যাওয়া দেশটির কোনো অংশ স্বাধীন হতে চায়, অপর অংশ আবার তাদের পিছু টেনে ধরে। সেই সময়ে আমাদের দেশের মানুষরা বসনিয়া-হেরজেগোভিনা, সার্বিয়া, কসোভো এসব নামের সাথে পরিচিত হন। সময়ের ব্যবধানে সেই স্মৃতিও মুছে গেছে মানুষের মন থেকে। এখন কসোভো নামটিই তাদের অচেনা। তাই কেউ কসোভো নিয়ে আলোচনায় অনেকে হয়তো বিস্ময়মাখা চোখ তুলে জানতে চাইবে, ‘কসোভো! সে আবার কোথায়?’
কসোভো ইউরোপের ক্ষুদ্র একটি মুসলিম দেশ। গৃহযুদ্ধ পেরিয়ে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটি এখন আর বিশ্বগণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয় না। কিন্তু এটা ঠিক যে, কসোভোর শরীর থেকে গৃহযুদ্ধের আগুনে পোড়ার ছাইও মুছে গেছে। এখন কেউ দেশটি ভ্রমণে গেলে দেখতে পাবে মনকাড়া অনেক কিছু। যদিও সার্বিয়ার সাথে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সার্বিয়ার ফোঁসফোঁসানি কমেনি। তারা এখনো ভাবে ও বলে, কসোভো কোনো দেশ নয়, এটি সার্বিয়ার অংশ। অন্যায়ভাবে একে সার্বিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। সার্বিয়ার এ ভাবনার সমর্থক হলো রাশিয়া ও বলকান অঞ্চলের আরো অনেক দেশ।
কসোভোর বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু আলবেনিয়ান গোত্রের, তাই দেশটির প্রধান ভাষাও আলবেনিয়ান। এ ছাড়া সে দেশে আছে সংখ্যালঘু সার্ব জনগোষ্ঠী, তাদের ভাষা আবার সার্বিয়ান। মজার ব্যাপার হলো, সে দেশের তরুণরা আবার ইংরেজি বলতেই ভালোবাসে। দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকই হলো ২৫ বছরের কম বয়সী।
কসোভো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ, যদিও দেশটির সমাজ অনেকটাই ধর্মনিরপেক্ষ। তাই রাস্তায় বের হলে আপনি হিজাব ও শালীন পোশাক পরিহিতা কিছু নারী যেমন দেখবেন, তেমনি দেখবেন অসংখ্য নারীকে, যাদের পরনে ইউরোপের পোশাক। যেহেতু মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই কসোভোতে আছে অনেক চমৎকার মসজিদ, যা পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
কসোভো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা পায় ২০০৮ সালে। এর মধ্য দিয়ে তারা হয় ‘ইউরোপের নবীনতম রাষ্ট্র’। স্বাধীনতার মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানী প্রিস্টিনার উপকণ্ঠে তারা নির্মাণ করেছে একটি স্মৃতিসৌধ। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে তারা স্মৃতিসৌধটিকে নতুন করে রঙ করে। রঙ নির্বাচন করা হয় ওই বছরের প্রতিপাদ্য বা থিমকে মাথায় রেখে।
স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধের পরই যে জিনিসটি পর্যটকদের আকর্ষণ করে সেটি হলো- ক্লিনটনের ভাস্কর্য। কোন ক্লিনটন চিনতে পারছেন তো? হ্যাঁ, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। গৃহযুদ্ধ চলাকালে তিনি কসোভোকে সাহায্য করেছিলেন এবং কসোভোকে রক্ষায় রাজি করিয়েছিলেন ন্যাটো জোটকে। কৃতজ্ঞ কসোভো সে কথা ভোলেনি। তারা ক্লিনটনকে তাদেরই একজন মনে করে। এর কাছেই আছে নারীদের পোশাক বিক্রয়কেন্দ্র। সেটির নাম হিলারি। ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারির নামে এই নামকরণ। পুরো বলকান অঞ্চলেই কফি কালচার ব্যাপক। কসোভোর যেখানেই আপনি যান না কেন দেখবেন, ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী প্রবীণরা চার-পাঁচজনের দলে ভাগ হয়ে কফি পান করতে করতে ধুমছে আড্ডা দিচ্ছে। প্রবীণদের এমনতর সখ্য দেখে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে নেই। কসোভোর রাজধানী শহরের পরিচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাটের আপনি খুঁজে পেতে পারেন অনেক ক্যাফে ও বার। এমনকি সরু রাস্তাতেও। যেগুলো মূল রাস্তার ক্যাফে ও বারের চেয়ে ভালো।
কসোভোর মানুষ আর বেড়ানোর কথা তো হলো। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, ইউরোপের ছোট এই দেশটি কিভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পরিণত হলো। আর এ দেশের সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব এতটা থাকছে কিভাবে? কসোভোর ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে এই সম্পর্কের ইতিহাস।
আসুন এবার কসোভো নামের দেশটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আমরা জেনে নেই। এর মাধ্যমেই আমরা জানতে পারব কিভাবে এটি ইউরোপের মুসলিম দেশে পরিণত হলো।
কসোভোর আয়তন ১০ হাজার ৯০৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশ মুসলিম। কসোভোর দক্ষিণ-পশ্চিমে আলবেনিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে মেসিডোনিয়া, পশ্চিমে ক্রোয়েশিয়া ও উত্তরে সার্বিয়া অবস্থিত। কসোভোর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাগত অবস্থা চমকপ্রদ। প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয় কসোভোর সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশটির ইসলামী ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তুরস্ক প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে। তুরস্কের সাথে দেশটির রয়েছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক।
কসোভোর ইতিহাস পাশের পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মতো। বাইজানটাইন ও সার্বিয়ানরা দীর্ঘদিন দেশটি শাসন করেছে। উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সময় সার্বিয়ানদের বিরুদ্ধে বিখ্যাত কসোভো যুদ্ধ হয়। কসোভো সমভূমির এই যুদ্ধ ইতিহাসে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ১৪৫৫ সালে এই অঞ্চলটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। এখানকার আলবেনীয় জনগোষ্ঠীর ওপর ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা এতটাই করারোপ করেছিল যে, মানুষের জীবন যাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। উসমানীয়দের বিজয়ের পর আলবেনীয় জনগোষ্ঠী একসাথে ইসলাম গ্রহণ করে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ৫০০ বছর উসমানীয় শাসনের অধীনে ছিল। এ সময় এ অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটে। ফলে উসমানীয় ঐতিহ্যের প্রতিফলন পাওয়া যায় কসোভোতে।
কসোভোর দুই জনগোষ্ঠী আলবেনিয়ান ও সার্ব এদের মধ্যে কখনোই বনিবনা ছিল না। এদের দীর্ঘ দিনের রেষারেষির এক পর্যায়ে ২০০৮ সালে একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে কসোভো। স্বাধীন কসোভোকে স্বীকৃতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বড় দেশগুলো। এ সময় সার্বিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায় রাশিয়া। রাশিয়ার মদদ পেয়ে সার্বিয়া রাজি হয় না কসোভোর স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে। কসোভোয় বসবাসকারী সার্বরাও কসোভোর স্বাধীনতা চায় না।
১৯৯০-এর দশকে যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পরপরই স্বাধীনতার ইচ্ছা প্রকাশ করে কসোভো। সার্বিয়া এর ‘জবাব’ দেয় কসোভোর আলবেনিয়ান জনগোষ্ঠীর ওপর নিষ্ঠুর হত্যা-দমন-পীড়ন চালিয়ে। ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপে এই হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটি এখন নিজেদের নতুন করে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। সার্বদের হাতে ধ্বংস হওয়া ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মীয় অবকাঠামো পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করেছে। কসোভোর ধর্মবিদ্বেষী কমিউনিস্ট শাসকরা বিগত ৭০ বছর ধরে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সব ধরনের ধর্মীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। সার্ব সেনারা ধ্বংস করে দিয়েছিল প্রায় দুই শতাধিক মসজিদ। এখন সেখানে আবার গড়ে উঠছে নতুন নতুন মসজিদ-মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু গত বছরের নির্বাচনে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দেশটিতে আবার শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিভক্ত হয়ে পড়ে দলগুলো। সরকার গঠনের জন্য কোনোভাবেই সমঝোতায় পৌঁছতে পারছিল না রাজনৈতিক দলগুলো। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পারে তারা। যার ফল প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন। আলবিন কুর্তি দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী। অনেকটা নাটকীয়ভাবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। পুরো দেশ এখন তাকিয়ে আছে তার দিকে। শেষ পর্যন্ত পারবেন তো দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে?