হিসাব মিলছে না ট্রাম্পের ভারত সফরের
মোদি ও ট্রাম্প - ছবি : সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত শেষ পর্যন্ত একটি প্রাচীর পাচ্ছেন, তবে তা যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সি সীমান্ত থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ভারতের আহমদাবাদে। ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া ট্রাম্পের দুদিনের ভারত সফরের সময় এই প্রাচীর তাকে স্বাগত জানাবে।
নগরী পরিভ্রমণের জন্য যেসব পথ দিয়ে যাবেন ট্রাম্প, সেগুলোর পাশে থাকা বস্তিগুলো আড়াল করতে নরেন্দ্র মোদি সরকার প্রাচীর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আহমদাবাদ হলো মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের নগরী। ২০১৪ সালের মে মাসে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এটি সফররত মেহমানদের গন্তব্য হিসেবে কাজ করছে।
কয়েক বছর আগে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আহমদাবাদ সফরের সময় বস্তিগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে লুকানো হয়েছিল। এবার ভারত সরকার আরো স্থায়ী প্রাচীর করতে চেয়েছে।
তবে নিশ্চিত অপ্রীতিকর কিছু ব্যর্থ আড়াল করার জন্য প্রাচীর নির্মাণের মতোই ট্রাম্পের সফরও বাস্তবে কিছু পাওয়ার চেয়ে আশাবাদ হয়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। পরিকল্পিত সফরের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন সরকার জেনারাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স (জিএসপি) ব্যবস্থার অধীনে ভারতের বাজার সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনায় পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ধাক্কা
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) অফিসের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারত এখন আর উন্নয়নশীল দেশ নয়। ফলে দেশটি আর অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়। এই অফিসের মতে, বিশ্ববাণিজ্যে যেসব দেশের ০.৫ ভাগের বেশি হিস্যা আছে, তাদেরকে উন্নত দেশ বিবেচনা করা উচিত। ফলে ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এখন আর অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়। অবশ্য বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই দেশগুলোর প্রতিটিরই মোট জাতীয় আয় ১২,৩৭৫ ডলারের কম।
আর ভারতে মার্কিন পণ্য ও পরিষেবার মোট রফতানি মূল্য ৫৮.৭ বিলিয়ন ডলার, আর ভারত থেকে আমদানি করে ৮৩.৯ বিলিয়ন ডলার। ভারত হলো যুক্তরাষ্ট্রের ৯ম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং জিএসপি সুবিধা ও উন্নয়নশীল দেশের তমকা থেকে উপকৃত হয়েছিল।
ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো গবেষক ফ্রাঙ্ক ও’ডোনেল ব্যক্তিগতভাবে এশিয়া টাইমসকে বলেছেন, বাণিজ্য সম্পর্ক হবে ভারতীয় নেতার জন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়।
তিনি বলেন, ট্রাম্পের সফরের সময় মোদির মূল লক্ষ্য হবে ভারতের মন্থর অর্থনীতিকে আরো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা যতটা সম্ভব হ্রাস করা। ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পিটার নাভারো ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধের কথা চিন্তা করেছিলেন।
আইটি শিল্পের সংস্থা ন্যাশকমের প্রধান দেবজানি ঘোষও ভারতীয় পেশাদার ব্যক্তিদের জন্য মার্কিন ভিসার প্রকৃতিতে বৈষম্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বিষয়টি ট্রাম্পের কাছে উত্থাপনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্ষেত্রে ও’ডোনেল বিশ্বাস করেন যে মার্কিন বাজারে ভারতের প্রবেশের সুযোগ ও শুল্ক হ্রাসের জন্য ট্রাম্পের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রস্তুতি নিয়েছেন মোদি। দিল্লি হারলে-ডেভিডসন মোটরসাইকেলের কর হ্রাস এবং দুগ্ধজাত সামগ্রী, টার্কি ও ফলের বাজার খুলে দিতে রাজি করাতে চাইছে ওয়াশিংটনকে।
নড়বড়ে কৌশলগত মিত্রতা
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক নিয়েও উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে। ভারত সরকারের সূত্র জানাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন চীনা প্রভাব সংযত করা ও ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখতে চাচ্ছে।
কোয়াড গঠনের চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এই জোটের অপর দুই সদস্য হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। তাদের লক্ষ্য চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরে চীনের উচ্চাভিলাষের রাশ চেপে ধরা।
তবে এ ধরনের অংশীদারিত্ব গঠনে দ্রুত সাড়া দেয়ার বদলে ভারত বেশ মন্থর গতিতে এগুতে থাকায় হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র স্থায়ী ভিত্তিতে নয়া দিল্লিতে তার দূতাবাসে ইউএস স্পেশাল অপারেশন কমান্ডের একজন অফিসারকেও পদায়ন করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিশেষ বাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক আরো গভীর করতেই এই উদ্যোগ।
বর্তমান কৌশলগত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অনেকটাই ঝুলছে কাশ্মির প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগের ওপর। এই অঞ্চলটি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দশক ধরে বিবাদ রয়েছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সাথেও বিষয়টি জড়িয়ে পড়েছে বলে ভারত সরকারের সূত্র এশিয়া টাইমসকে জানিয়েছে।
ও’ডোনেল বলেন, মোদি বাণিজ্য সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কও গভীর করতে চান। তিনি ২৪টি এমএইচ-৬০আর সিহক হেলিকপ্টার কেনাও নিশ্চিত করতে চান ট্রাম্পের সফরের সময়। এছাড়া আরো কিছু সামরিক ক্রয়ও রয়েছে তালিকায়।
তিনি বলেন, কাশ্মির প্রশ্নে মোদি চান ট্রাম্পের কাছ থেকে সমর্থনসূচক কিছু শুনতে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কংগ্রেসে কাশ্মিরে দমন অভিযানের ব্যাপারে যে বিরূপ মনোভাব রয়েছে, তা দূর করতে এমনটা দরকার ভারতীয় কূটনীতিবিদদের।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের সাথে মার্কিন সম্পর্ক শিথিল করার চেষ্টা করবেন মোদি। তিনি চাইবেন ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে একই ফ্রেমে রাখতে ও পাকিস্তানকে বৈরী শিবিরের সমর্থক হিসেবে ছুঁড়ে ফেলতে।
এশিয়া টাইমস