ভারতীয় মুসলিমদের নতুন আন্দোলন

শারিক লালিওয়ালা | Feb 16, 2020 08:11 pm
ভারতীয় মুসলিমদের নতুন আন্দোলন

ভারতীয় মুসলিমদের নতুন আন্দোলন - ছবি : সংগৃহীত

 

 নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিকপুঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ভারতের মূলধারার রাজনৈতিক শব্দভাণ্ডারে সেক্যুলারবাদকে নতুন করে সন্নিবিষ্ট করেছে। রাজনৈতিক ধারার এই পরিবর্তন এসেছে মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এবং তারপর তা ছাত্র, নাগরিক সমাজ গ্রুপ ও রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করে নেয়। মুসলিম সম্প্রদায় এসব নাগরিকত্ব উদ্যোগগুলোর বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দিচ্ছে তা সব ভারতীয়ের জন্য নিশ্চিত করা সাংবিধানিক অধিকারের ভাষা।

মৌলিক অধিকারের প্রতি এই গুরুত্বারোপের মূলে রয়েছে এই সাধারণ বিচক্ষণতা যে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের শ্রেষ্ঠত্বের রাজনীতি ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে চরমপন্থী প্রবণতা উস্কে দিতে পারে। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিধ্বংসী আক্রমণ প্রতিনিয়ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বৈরিতা বাড়াচ্ছে। এটি তাদের আর্থ-সামাজিক প্রান্তিকরণ বাড়িয়ে তুলছে। কেবল পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসদাচরণের মাধ্যমেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব প্রকট হচ্ছে না, সেইসাথে আইনের মাধ্যমেও তা করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গুজরাটের ‘ডিস্টার্বড এরিয়াস অ্যাক্ট’ গুজরাটের নগর এলাকায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্পত্তি লেনদেনের ওপর মারাত্মক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে ‘ জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষার’ নামে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো স্বাধীনতার পর এখনই মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বর্তমান লোকসভায় মুসলিম এমপি মাত্র ২৫ জন (৫৩৫ জনের মধ্যে)। তা গত লোকসভার চেয়ে মাত্র ছয়জন বেশি। অর্থাৎ মুসলিমরা জনসংখ্যার দিক থেকে ১৪.২ ভাগ হলেও লোকসভায় তাদের হিস্যা হচ্ছে মাত্র ৪.৫ ভাগ।২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিজেপির ১,৪১৮ জন এমএলএর মধ্যে মুসলিম ছিলেন মাত্র চারজন।
তা সত্ত্বেও ভারতীয় মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান হারে ভারতীয় মুসলিমদের অদৃশ্যমানতা (হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টিতে ভারতীয় সমাজের পঞ্চম বাহিনী) তাদেরকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেয়নি। ব্যতিক্রম কেবল জম্মু ও কাশ্মির ও কেরালার কয়েকটি উদারহণ। বিপরীত দিকে সাম্প্রতিক গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভের মাধ্যমে ভারতের মুসলিমরা সেক্যুলারবাদের নতুন পরিভাষা প্রবর্তন করেছেন।

অধিকারভিত্তিক ভাষা
গত কয়েক বছরে মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কৌশলের মৌলিক পরিবর্তন প্রকাশ করছে তা। মুসলিমরা এোখন ইসলামি সংস্কারবাদীদের গুরুত্ব দেয় ধর্মীয়-নৈতিক কর্তৃব্যের বদলে অধিকারের ভাষার ওপর জোর দিচ্ছে।
মুসলিম নারীবাদী গ্রুপগুলো প্রায় সবসময়ই মানবাধিকারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে। তারা দরগায় প্রবেশে নারীদের নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার, ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে তাদরে অভিমতকে গুরুত্ব দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। অবশ্য বিহার, উত্তর প্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের মতো স্থানে নিম্ন বর্ণের ও দলিত মুসলিমেরা প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতির মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে বর্ণভিত্তিক আর্থ-সামাজিক পশ্চাদপদতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

অধিকারভিত্তিক দাবির কথা আরো আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে বলার মাধ্যমে মুসলিমরা ক্রমবর্ধমান হারে রাজনৈতিক-সামাজিক ও শিক্ষাকে অগ্রগতির বাহন হিসেবে গ্রহণের ওপর জোর দিচ্ছে। ভারতের বেশির ভাগ মুসলিম সন্তান সেক্যুলার স্কুলেই যাচ্ছে। ২০০৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মুসলিম শিশুদের মাত্র ৭ ভাগ যাচ্ছে মাদরাসায়। এদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক ধর্মীয় শিক্ষাকে খণ্ডকালীন পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। তারা মূলধারার স্কুলেও যোগ দেয়।
এমনকি ইসলামপন্থীরা পর্যন্ত অধিকারকেন্দ্রিক শব্দভাণ্ডারের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন হচ্ছে। অবশ্য তারা ব্যক্তি আইন ও ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করার মতো ইস্যুতে সাংবিধানিক আদর্শের চেয়ে ধর্মীয় নৈতিকতাকেই প্রায়ই অগ্রাধিকার দেয়।

নতুন প্রতীক, নতুন পরিচিতি
হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির গবেষণাগার হিসেবে পরিচিত রাজ্য গুজরাটে সক্রিয় দুটি ইসলামি সংস্কারবাদী সংগঠনও সংস্কারবাদী কার্যক্রমের চেয়ে আর্থ-সামাজিক উদ্বেগগুলো দূরের প্রতি নজর দিতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এসব গ্রুপের পরিচালিত মুসলিম দাতব্য স্কুলগুলোতে ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা শ্রেণিকক্ষ রাখা ও আংশিক ধর্মীয় সিলেবাস রাখলেও সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় নির্ধারিত কারিকুলামই অনুসরণ করে। ফলে মাদরাসাগুলো কার্যত সেক্যুলার স্কুলের পাঠদানই করে থাকে। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট : মুসলিম শিশুদের মধ্যে দক্ষতার বিকাশ ও শেখার সামর্থ্য বৃদ্ধি। এর মাধ্যমেই তারা তাদের নির্ধারিত মর্যাদা লাভ করার প্রয়াস চালাচ্ছে।
ইরফান আহমদ তার ২০০৯ সালের ইসলামিজম অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে জানিয়েছেন, ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামি হিন্দ ভারতবর্ষ বিভক্তির সময় সেক্যুরার গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে থাকলেও এখন তারা, বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে, ধর্মীয় বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিকব্যবস্থার প্রতি আস্থা স্থাপন করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি জামায়াতের সমর্থনের আলোকে এই আদর্শগত পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেবল জামায়াতই নয়, আসাদুদ্দিন ওয়াইসির অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন ও ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়াও একই মতাদর্শ গ্রহণ করেছে।

এই পরিবর্তনের ফলে একই ধরনের হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতায় থাকা অন্যান্য প্রান্তিক গ্রুপগুলোর সাথেও সংহতি বৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছে মুসলিম গ্রুপগুলো। গত কয়েক বছর ধরে ভীম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদের প্রতি মুসলিমদের বিপুল সমর্থন এই প্রবণতাকেই প্রকাশ করছে। অবশ্য মুসলিম গ্রুপগুলোর মধ্যে আশরাফ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি হওয়ায় মুসলিমদের সাথে হিন্দু দলিতদের জোট তেমন দানা বাঁধেনি। মুসলিম গ্রুপগুলের আর্থ-সামাজিক আগ্রহ দলিতদের নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলোর সাথে মেলে না।
মুসলিমদের এই নতুন বিশ্বাস গ্রহণ করার কারণ হলো সেক্যুলারবাদের উদার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত দলগুলো মোটামুটিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের প্রতীক গ্রহণ করার পরিণাম।

সেক্যুলারবাদের উদার অভিভাবকেরা মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক উদ্বেগগুলো এড়িয়ে গেছে। আরো খারাপ বিষয় হলো, মুসলিমদেরকে পুরনো রীতিনীতি আঁকড়ে ধরে থাকা সম্প্রদায় হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এসব বিভেদরেখা প্রকাশ করার মাধ্যমে, যদিও এখনই তা বলার সময় আসেনি, ভারতীয় মুসলিমদের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ কেবল সেক্যুলার গণতন্ত্রকেই নয়, বরং এমনকি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের জন্যও নতুন জীবনের ব্যবস্থা করেছে।

স্ক্রল.ইন


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us