আফগান যুদ্ধ : যেভাবে পরাজয়
আফগান যুদ্ধ : যেভাবে পরাজয় - ছবি : সংগ্রহ
শেষ খবর অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান একটি শান্তি চুক্তি চূড়ান্ত করেছে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শর্ত সাপেক্ষে এটি অনুমোদন করেছেন।
এটা একটি বড় অগ্রগতি, কারণ এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধটির অবসান ঘটাবে এবং আফগানদেরকে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ এনে দেবে।
সম্ভাব্য চুক্তির ফলে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে এবং এর বিনিময়ে তালেবানরা সহিংসতা কমিয়ে আনবে, আল-কায়দার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে এবং এরপর আন্ত:আফগান সংলাপে নিয়োজিত হবে, যেন সাবলীলভাবে একটি নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়া যায়। আবারো যেন তালেবান যুগ ফিরে না আসে তা নিশ্চিত করবে এই চুক্তি।
অত্যন্ত বিবাদপূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই চুক্তি সই হচ্ছে, যা এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি তালেবানকে একটি শিক্ষা দেয়া ও আফগানিস্তানে আরো সেনা মোতায়েনের শপথ নিয়েছিলেন। তার এই উদ্যোগকে আফগানিস্তানে ‘ট্রায়াম্ফিয়ান সার্জ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিলো।
এই সার্জ বা তরঙ্গের মানে ছিলো তালেবানকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করা। কিন্তু এযাবতকালের সবচেয়ে বেশি বোমা ফেলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেটা করা সম্ভব হয়নি। ট্রাম্পের তিন বছরের শাসনামলে আফগানিস্তানে ১৯,১৪৬ দফা বিমান হামলা চালানো হয়। অথচ ওবামার পুরো প্রথম মেয়াদে বিমান হামলা করা হয়েছিলো ১৮,৭৫৮ বার।
এমনকি স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগান রিকনসট্রাকশন (সিগার)-এর সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয় যে তালেবানের সমাপ্তির সূচনা ঘটাবে বলে যুক্তরাষ্ট্র যে শপথ নিয়েছিলো সেই লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি।
অন্যদিকে তালেবানের হামলা বেড়েছে এবং বহু সংখ্যক মার্কিন ও আফগান সরকারি সেনাকে হত্যা করে তারা দেখিয়েছে যে ১৯ বছরের যুদ্ধে তারা এখন যেকোন সময়ের চেয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে।
সিগারের রিপোর্টে বলা হয়, তালেবানরা ২০১৯ সালের শেষ চার মাসে ৮,২০৪টি হামলা করেছে। এই সংখ্যা ২০১০ সালের পর থেকে যেকোন বছরের শেষ দিকে চালানো হামলা থেকে বেশি। ২০১০ সালের শেষ চার মাসে হামলা করা হয়েছিলো ৭,৬৮৫টি।
রিপোর্টে বলা হয় যে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানরা যেকোন মাসের তুলনায় শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সংখ্যক কার্যকর হামলা চালিয়েছে। ২০১০ সাল থেকে সিগারের রিপোর্ট তৈরি শুরু হয়।
যখন মার্কিন সেনা বৃদ্ধি ব্যর্থ হয় এবং তালেবান হামলা জোরদার ও ক্রমাগত সুক্ষ্ম হয়ে ওঠে তখন মার্কিন-প্রশিক্ষিত আফগান নিরাপত্তা বাহিনী ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলে ভালোর পক্ষে কোন পরিবর্তন আনতে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রচেষ্টা ২০০১ সালের পর সবচেয়ে বেশি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
তালেবানরা বছরের পর বছর হামলা চালিয়ে গেলেও তারাও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে সেটা বলা যাবে না। আফগান সমাজে শান্তির দাবি এখন যেকোন সময়ের চেয়ে তীব্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর মধ্যেও এই দাবি উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তালেবনরা তাদের ওয়েবসাইটে যেসব বিবৃতি প্রকাশ করছে তাতে মনে হয় তারা শান্তির এই দাবির প্রতি অনেক বেশি মনযোগ দিয়েছে। এমন একটি বিবৃতিতে বলা হয়: সাম্প্রতিক সময়ে শান্তি ও দখলদারিত্ব অবসানের দাবি দেখা যাচ্ছে এবং দেশের প্রতিটি কোণ থেকে এই দাবির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যক্তি, রাজনৈদিক দল ও সমাজের অন্যান্য স্তরের সমাবেশগুলো থেকে আমেরিকারদের প্রতি শান্তিপূর্ণ সামাধানের চুক্তি সই এবং আরো দাবি, আপত্তি ও অযুহাত পরিহারের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
একইভাবে সত্য হলো শান্তির পক্ষে জনগণের এই দাবির কারণে কথিত ‘ট্রায়াম্ফিয়ার সার্জ’ দিয়ে তালেবানকে আলোচনার টেবিলে আনা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় স্বার্থেই এখন যুদ্ধ বন্ধ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্রয়োজন হয়েছে তালেবানদের আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে এনে চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি করানোর।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবেশও চুক্তি সইয়ের অনুকূল। ইমপিচমেন্ট থেকে উৎরে যেতে পেরেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা পরাস্থ, তার পুন:নির্বাচিত হওয়ার সুযোগও বেড়েছে।
বর্তমান এই বিজয়ী রাজনৈতিক পরিবেশ ‘অন্তহীন যুদ্ধটির’ পরিসমাপ্তি ঘটানোর লক্ষ্য হাসিলে ট্রাম্পের সামনে অবাধ সুযোগ এনে দিয়েছে। আগামী নির্বাচনের মওসুমে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন বার্নি স্যান্ডার্স। তখন আফগান যুদ্ধ একটি ইস্যু হতে পারে। ট্রাম্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণা হবে যুদ্ধের অবসান।
অন্য কথায় ট্রাম্প্র প্রশাসন যদি দেখাতে পারে যে মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান থেকে দেশে ফিরে আসছে তখন ট্রাম্প শুধু তার ২০১৫ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পুরণেরই দাবি করতে পারবেন না, একে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী পয়েন্ট হিসেবেও উপস্থাপন করতে পারবেন।
আর একারণেই পরিশেষে শান্তি চুক্তির সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
সূত্র : এসএএম