নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সমীকরণ
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সমীকরণ - নয়া দিগন্ত
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণে নানা অনিয়ম আর কারচুপির অভিযোগ তুললেও শূন্য হওয়া জাতীয় সংসদের পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেনÑ দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে মানুষ আজ অতিষ্ঠ। গণতন্ত্রের সব দরজা প্রায় বন্ধ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ঠিকমতো কাজ করছে না। বিএনপি হচ্ছে উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাসী। যখন যেখানে গণতন্ত্রকে কাজে লাগানো যায় সেটাই করে বিএনপি। বর্তমানে সংসদীয় শূন্য আসনের নির্বাচনে সে কারণেই নিয়ম রক্ষার্থে অংশ নিচ্ছে বিএনপি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা অংশ নেবো। উপনির্বাচনগুলোতেও আমরা অংশ নিচ্ছি। সেই সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনেকে প্রশ্ন করেছে আপনারা তো দেখছেনই যেসব নিয়ে যাচ্ছে। তা হলে কেনো নির্বাচনে যাচ্ছেন? এর উত্তর হলোÑ বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক দল। আমরা বিশ্বাস করি ভোটই গণতন্ত্রের একমাত্র পথ। এ দিকে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলের হাইকমান্ডের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে কাজও শুরু করেছেন। পুরনো প্রার্থী তথা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদেরকেই ফের উপনির্বাচনে মনোনয়ন দিতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। তবে দু-একটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তনও হতে পারে। সম্প্রতি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংসদীয় উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে আলোচনা ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর জাতীয় সংসদের তিনটি আসনে উপনির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভোটের প্রস্তুতি নিতে মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিএনপির হাইকমান্ডের এমন নির্দেশে সম্ভাব্য প্রার্থীরাও দলীয় মনোনয়ন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। ঢাকায় অবস্থান করে সিনিয়র নেতাদের বাসা ও অফিসে গিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথেও যোগাযোগ করছেন তারা।
এরই মধ্যে ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনে আগামী ২১ মার্চ ভোটগ্রহণের দিন ধার্য রেখে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ীÑ এ তিন সংসদীয় আসনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ১৯ ফেব্রুয়ারি, মনোনয়নপত্র বাছাই ২৩ ফেব্রুয়ারি এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৯ ফেব্রুয়ারি। বাকি দুই আসন বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিতেও নানা তৎপরতা শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
জানা গেছে, ঢাকা-১০, বাগেরহাট-৪ ও গাইবান্ধা-৩ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে মোট সাতজন মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এরা হলেনÑ ঢাকা-১০ আসনে ধানমন্ডি থানা বিএনপির সভাপতি শেখ রবিউল ইসলাম রবি, গাইবান্ধা-৩ আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি ডা: মাইনুল হাসান সাদিক, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম ও জেলা বিএনপির সদস্য ড. মিজানুর রহমান সরকার মাসুম এবং বাগেরহাট-৪ আসনে কাজী খায়রুজ্জামান শিপন, মনিরুল হক ও কাজী মনিরুজ্জামান। গতকাল শুক্রবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ফরম সংগ্রহ করেন। মনোনয়ন ফরম জমা দেয়ার পর বিএনপির পার্লামেন্টারি মনোনয়ন বোর্ড সাক্ষাৎকার নিয়ে চূড়ান্ত প্রার্থী ঠিক করবে। গাইবান্ধা-৩ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও জেলা বিএনপির সদস্য ড. মিজানুর রহমান মাসুম বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে এলাকাবাসীর সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক। তাদের সুখে-দুখে আমি পাশে থেকেছি। এই মুহূর্তে আমি নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছি। এ লক্ষ্যে জেলা ও থানার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তারা আমার সাথে আছেন। তিনি বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ দিন ধরে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছি। আশা করি দল আমাকে মূল্যায়ন করবে।
জানা গেছে, আসন্ন উপনির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে দলের হাইকমান্ড মত দিলেও এর বিরোধিতা করছেন দলেরই অপর একটি অংশ। সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। এ সময় কয়েকজন সদস্য সদ্যসমাপ্ত ঢাকার দুই সিটির ভোটের চিত্র তুলে ধরে বলেন, এর পরও বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে যাওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। দলের চেয়ারপারসনের মুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবে সিটি নির্বাচনে যাওয়ার যৌক্তিকতা নেতাকর্মীদের কাছে বলা হয়েছিল কিন্তু এবার কী বলার আছে? তাই এভাবে ভোটে অংশ নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বৈধতা দেয়ার কোনো মানে হয় না। তবে স্থায়ী কমিটির কয়েক নেতা নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনকে বেগবান করা যাবে। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচনে না যাওয়ার বিকল্প কী আছে? নির্বাচনের মধ্যে থাকলে নেতাকর্মীরাও চাঙ্গা হবে। তাদের এমন মতামতের সাথে একমত পোষণ করে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনে না গিয়ে আমাদের কী করার আছে? স্থায়ী কমিটির সবার মতামত শুনে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখান।
জানা যায়, ঢাকা-১০ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। তিনি ছাড়া এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হতে চান ধানমন্ডি থানা বিএনপির সভাপতি শেখ রবিউল আলম রবি। তিনি বলেন, বিগত আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে ছিলাম, এখনো আছি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমাকে দল থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় আমি কারাবন্দী থাকায় নির্বাচন করতে পারিনি। দীর্ঘ দিন কারাভোগের পর জামিন পেয়েছি। দল নির্বাচনে অংশ নিলে আমি এ আসন থেকে ধানের শীষের প্রার্থী হতে চাই। গাইবান্ধা-৩ আসনে একাদশ নির্বাচনে জোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে (কাজী জাফর) ছেড়ে দেয়া হয়। দলটির ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মরহুম ড. টি আই ফজলে রাব্বিকে ধানের শীষের মনোনয়ন দেয়া হয়। আসন্ন উপনির্বাচনে এ আসন থেকে বেশ কয়েকজন নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। বাগেরহাট-৪ আসনটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে দেয়া হয়। ওই নির্বাচনে জেলা জামায়াত নেতা অধ্যাপক আবদুল আলিম ধানের শীষের হয়ে নির্বাচন করেন। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে জামায়াত আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেক্ষেত্রে এবার বিএনপির কাউকে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে এমনিতেই গণতন্ত্রের সব পথ রুদ্ধ। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আজ পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। তবে বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিয়ম রক্ষার জন্য উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।