সিটি নির্বাচনে জনগণের নীরব প্রতিবাদ
সিটি নির্বাচনে জনগণের নীরব প্রতিবাদ - ছবি : সংগৃহীত
কিছু দিন আগে রাজধানী ঢাকায় যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেল, তা নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ এখনো চলছে। নির্বাচনের সার্বিক চিত্র নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের জন্য একটি আঘাত। নির্বাচন কমিশন যে ২৫ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলেছে; যদিও একে জনগণের ম্যান্ডেট বলা যায় না এবং সাধারণ মানুষের প্রায় কেউই বলছেন না যে নির্বাচনটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচনের প্রতি জনগণের যে অনীহা আমরা দেখেছি, ভোটাররা যে অনাস্থা প্রকাশ করেছেন সেটি একটি অশুভ লক্ষণ। মনে হয় সাধারণভাবে নির্বাচনী সিস্টেমের ব্যাপারে জনগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আমি বলব, এটা আমাদের চোখ খুলে দেয়ার নির্বাচন। যাকে বলে আই-ওপেনিং।
নির্বাচনের ফল কী হবে তা নিয়ে নগরবাসীর মনে কমই সন্দেহ ছিল। শুধু ভোটের ফলের মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত হয়েছে। ঢাকার দুই অংশেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনের পর ফলাফল নিয়ে বলতে গেলে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। বিশ্লেষণ হচ্ছে এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে। নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলও কিছুটা বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মিডিয়াকে বলেছেন, ভোটাররা যে অনীহা দেখিয়েছে, সেটি ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়’। যে দিক থেকেই দেখা যাক না কেন, নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি মূল ইস্যু হয়ে উঠেছে।
নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ না থাকার অনেক কারণ রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, ক্ষমতাসীন দল যেভাবেই হোক জিতবে। যেহেতু বহু মানুষ নির্বাচনকে আর সবার জন্য সমান প্রক্রিয়া বলে মনে করে না, সে কারণেই এই স্বল্প উপস্থিতি। তা ছাড়া প্রতিযোগিতা না থাকায় নির্বাচনী রাজনীতি নিম্নমুখী হয়েছে। যদিও এই কলামেই আমি আমাদের নির্বাচনপ্রক্রিয়া পাল্টানো দরকার বলে উল্লেখ করেছিলাম। আমার এমন মতামতের কারণ হলো আমাদের দেশে পশ্চিমা গণতন্ত্র প্রযোজ্য নয়। কারণ পশ্চিমা গণতন্ত্রের পূর্বশর্তগুলো আমাদের এখানে অনুপস্থিত বা সেগুলো পূরণ করা হয়নি। পশ্চিমা জগতের মানুষ তাদের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা ইস্যু বোঝে, কারণ সেখানে প্রায় শতভাগ মানুষ শিক্ষিত। ফলে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে তারা কে কোন দল করছে সেটি কমই আমলে নেয়। তারা ভোট দেয় কোনো ইস্যুতে। সম্প্রতি ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আমরা এটা দেখেছি। তাদের লিখিত কোনো সংবিধান নেই। কিন্তু তাদের প্রথা ও প্রজ্ঞা এত প্রবল যে, যখন কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন সবাই এক জায়গায় বসে আইন প্রণয়ন করে। আমাদের দেশে এমনটা কি হওয়া সম্ভব? এমনটা হওয়া এখানে বরং বিপজ্জনক। আমাদের সংবিধানে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স অনুপস্থিত। আর সময়ে সময়ে যেসব পরিবর্তন করা হয় সেগুলো চরম বা প্রান্তিক ধরনের।
তবে সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণের দিকে না গিয়ে আমি সার্বিক চিত্রটিকে ইতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, অগ্রগতি লাভের জন্য নেতিবাচক বিষয়গুলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। আমি নির্বাচিত দুই মেয়র এবং ভোটারসহ যারাই অংশগ্রহণ করেছেন তাদেও সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই। এটা এ কারণে যে, তাদের সম্মিলিত কর্মকাণ্ড বা তৎপরতার কারণেই আজ আমরা আমাদের দেশের গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ অনেক ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছি। এর কৃতিত্ব বিজয়ী ও বিজিত উভয় পক্ষেরই। কিন্তু যারা বিজয়ী হয়েছেন জয়টিই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জের।
স্থানীয় সরকারে যারা নির্বাচিত হন তারা পার্লামেন্টে আইন পাস করতে নির্বাচিত হন না। এই নির্বাচনে ব্যক্তিরা নির্বাচিত হন স্থানীয় জনগণের কল্যাণ করতে। অর্থাৎ এখানে কর্ম মুখ্য। যদি তাই হয়; তাহলে নির্বাচনের আগে আমার প্রস্তাব ছিল আমরা কি এমন কোনো ব্যবস্থার দিকে যেতে পারি না যেখানে জনগণ কোনো ব্যক্তির বদলে কর্মভিত্তিক এজেন্ডাকে ভোট দেবে? বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হচ্ছে সেটি উল্টো দিক থেকে ভাবলে কেমন হয়, আমরা প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে তার কর্মসূচিকে ভোট দেবো। দলীয় প্রার্থী থাকতে পারেন, দল থেকে মনোনয়নও দেয়া হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক প্রার্থীর একটি কর্মপরিকল্পনা থাকবে। স্থানীয় সমস্যাগুলোর ভিত্তিতে তৈরি করা ওই কর্মপরিকল্পনায় চার বা পাঁচ বছরের মেয়াদকালে যেসব কাজ করা হবে সেগুলো তুলে ধরা হবে। তখন জনগণ প্রার্থীর বদলে তার কর্মসূচিকে ভোট দিতে উৎসাহিত হবে। তখন জনগণ অগ্রাধিকার বাছাইয়েরও সুযোগ পাবে।
যারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করেছেন তারা যাদের নিয়ে কাজ করবেন তারা হলো স্থানীয় জনগণ। কিন্তু স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়ন কখনো সফলতার মুখ দেখে না। উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে যে, জনগণকে সমৃদ্ধ করা গেলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। বিজয়ী দুই প্রার্থীই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক ভালো ও জনকল্যাণকর এজেন্ডা দিয়েছেন। এই এজেন্ডাগুলোর সাথে স্থানীয় জনগণকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায় সেই চেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের সত্যিকারের দুর্দশাগুলো দূর করা গেলে দেশকে উন্নয়নের পথে, গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা শুধু বিপর্যই ডেকে আনবে। তাই আমি বিষয়টিকে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথটিকে সংশোধনের জন্য এ দেশের জনগণের সামনে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে মানুষের মনে যে ভয়াবহ অনীহা তৈরি হয়েছে তা দূর করতে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে যারা বিজয়ী হয়েছে তাদের জন্য। তাদের আন্তরিকভাবে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। তাদের স্থানীয় সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে, যেসব সমস্যা প্রতিনিয়ত জনগণ মুখোমুখি হচ্ছে। সড়ক, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ ইতাদিসহ আরো যেসব নাগরিক পরিষেবা রয়েছে সেগুলো বাড়ানোর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে প্রতিটি নাগরিকের অভিযোগ এসব ইস্যুতেই। দরদি মন নিয়ে এসব সমস্যা দূর করতে হবে।
স্থানীয় সমস্যাগুলো দূর করা গেলেই স্থানীয় সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে। তারা ভোটকেন্দ্রমুখী হবে। সাম্প্রতিককালে আমরা মশা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণসহ আরো বেশ কিছু নাগরিক ইস্যুতে দেখেছি নগর সরকার তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। নির্বাচনী প্রচারণায় সব প্রার্থীই অঙ্গীকার করেন যে, তিনি নির্বাচিত হলে জনগণের সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু অঙ্গীকার ও বাস্তবায়ন করার মধ্যে ব্যবধান অনেক। অঙ্গীকার করা সহজ। বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। এই বাস্তবায়নের কাজটিই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে নয়, গণতন্ত্রের স্বার্থেও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা উচিত তাদের।
নির্বাচিত নেতারা যেসব নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছেন সেগুলো বাস্তবায়ন করা এবং এর সাথে বিরোধী দলের বা যারা পরাজিত হয়েছেন তাদের সম্পৃক্ত করা, নির্বাচনী সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আচরণ না করে সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত যাতে পরাজিত পক্ষের মধ্যেও অংশগ্রহণের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ উন্নয়নের জন্য আমি টোটাল পার্টিসিপেশনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। এটাও বিজয়ী পক্ষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। বিরোধী পক্ষ যেন সমালোচনা করার সুযোগ না পায়। তারা যেন বলতে বাধ্য হয় যে হ্যাঁ, যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা জনগণের জন্য কাজ করছেন। এভাবে এগিয়ে যেতে পারলে আমি আশার আলো দেখি।
এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই মানুষ এখন নির্বাচনের ব্যাপারে পুরোপুরি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটা শুভ লক্ষণ নয়। একে দাবানলের সূচনা বলা যায়। এই দাবানল শুরুতেই নির্বাপিত করার চেষ্টা না করা হলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বাধ্য। নির্বাচন কেন্দ্র থেকে জনগণের দূরে থাকা আসলে তাদের তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। মোট ভোটারের যে ক্ষুদ্র অংশের ভোটে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন তাকে জনগণের প্রতিনিধিত্ব বলা যায় না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কথা যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলেও দেখব যে দলটি জাতীয় নির্বাচনে যে ভোট পেয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এসে তাদের প্রার্থীরা ভোটপ্রাপ্তিতে সেই অনুপাতের ধারে কাছেও যেতে পারেননি।
আরেকটি বিষয় হলো এবারের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ১৪ জন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। ঢাকা উত্তরে ৯ জন এবং দক্ষিণে পাঁচজন। এর মানে হলো নির্বাচনের ফলাফল আমাদের কাছে যেসব বিষয় তুলে ধরছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো গণতন্ত্রের প্রতি অনীহা, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতি কোনো আস্থা না থাকা। বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়ী হওয়াও কিন্তু দলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের জন্য একটি সিগন্যাল। এতে বোঝা যায় উপরের নেতারা মাঠের পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। মূল্যায়নের এই ঘাটতি একটি বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।
তাই আমি মনে করি সার্বিক এই উদাসীনতা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। প্রবাদই আছে : নীরবতা সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। এটা সামাজিক প্রতিবাদ। যেকোনো সময় তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তুমি প্রতিবাদ করছ না, মনের মধ্যে ক্ষোভ পুষে নিয়ে চুপ করে বসে আছো। তোমার অনেক অভিযোগ নিয়ে তুমি বসে আছো। তাই তুমি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছ না। অর্থাৎ নির্বাচনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, জনগণ এভাবে নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই নীরব ক্ষোভ ঘনীভূত হয়ে একসময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাই সতর্ক হতে হবে এখনই।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com